অথবা, ১৯৭০ সালের নির্বাচন কিভাবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করে।
অথবা, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে। তুমি কি এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত? আলোচনা কর।
অথবা, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব অনন্য- ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের রাজনৈতিক তাৎপর্য অধিক। কারণ এটা ছিল বাঙালি জাতির পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অকল্পনীয় বিজয় সুদীর্ঘ ২৫ বছরের পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর দুঃশাসন ও শোষণের হাত থেকে বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও মুক্তি লাভের বহিঃপ্রকাশ। আওয়ামী লীগের ‘ছয় দফা’ কর্মসূচির উপর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ দলটিকে দেশ শাসনের ভার প্রদান করে। আওয়ামী লীগের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা মূর্ত প্রতীকরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব : নিচে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. বাঙালি জাতিয়তাবাদের বিজয় : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ভিত্তি লাভ করে । এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই বিজয়।
২. বাঙালিদের আত্মপ্রত্যয়ের সৃষ্টি : ১৯৭০ সালের নির্বাচন বাঙালিদের স্বাধিকারের দাবিতে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য জোরদার হয়েছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় বাঙালিদের আত্মবিশ্বাস শক্তিশালী করে।
৩. ঔপনিবেশিক শাসন হতে মুক্তির চেতনা : এ নির্বাচনে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেন। আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানিদের সত্যিকারের প্রতিনিধি তা বিশ্ববাসীর চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠে। এর ফলে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বিশ্বের জনসমর্থন লাভ করা সহজতর হয়।
৪. পাকিস্তানের মৃত্যুর বার্তাবাহক : আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে একটিও আসন পায়নি। অন্যদিকে, Peoples Party পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে একটিও আসন পায়নি। নির্বাচনে এ ধরনের রায় এটাই প্রমাণ করে যে, পাকিস্তানের এক অংশের জনগণ অন্য অংশকে সমর্থন করে না। এ নির্বাচনের রায়ই পাকিস্তানের মৃত্যুর কারণ।
৫. জাতির অনৈক্যর প্রকাশ : এ নির্বাচনে প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ঐক্যের কোন ভিত্তি নেই। পাকিস্তানের দু’অংশের জনগণের আশাআকাঙ্ক্ষা ও মানসিকতা ভিন্নমুখী। এ সকলের মধ্যে একত্রিকরণ করা কঠিন ব্যাপার ।
৬. সংগ্রামী চেতনার উদ্ভব : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতির মধ্যে সংগ্রামী চেতনার উন্মেষ ঘটে। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় বাঙালিদের স্বাধীনতাযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছে।
৭. পাকিস্তানের ব্যর্থ প্রত্যাশা : এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যাশাকে ব্যর্থ করে দেয়। কারণ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রত্যাশা করেছিল আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে অন্যান্য দলের সাথে জোট করতে বাধ্য হবে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু দেখা যায় এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব এক জয়ের প্রেক্ষিতে বাঙালি জনগণের মধ্যে একটি আত্মপ্রত্যয়ের সৃষ্টি হয় এবং তারা উপলব্ধি করে যে, এ বিজয় ছয়দফার বিজয়, এ বিজয় পশ্চিম পাকিস্তানি উপনিবেশ থেকে বাঙালি
জাতির মুক্তির শুভ সূচনা।
৮. ৬ দফাকে স্বীকৃতি দান : ১৯৬৬ সালে প্রণীত ৬ দফাকে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণা করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ব্যাপকভাবে ভোট প্রদানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ৬ দফাকে তাদের ন্যায্য দাবি হিসেবে গ্রহণ করেন।
৯. প্রথম সাধারণ নির্বাচন : ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ছিল প্রাদেশিক নির্বাচন। ১৯৭০ সালে একই সাথে কেন্দ্রীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল । কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঐ নির্বাচন ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
১০. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন : ১৯৭০ সালের নির্বাচন ক্ষমতাসীন সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় এটি ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ নির্বাচন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সুসম্পন্ন হয়।
১১. পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের স্বার্থ ও আশাআকাঙ্ক্ষা ভিন্নতার অভিব্যক্তি : এ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক বৃহৎপুঁজি ও সামরিক আমলাচক্রের দৌরাত্ম্যকে বাঙালি জনগণ প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের দৃষ্টিভঙ্গি স্বার্থ ও আশাআকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ পৃথক।
১২. সংবিধান প্রণয়ন : একটি দেশ পরিচালনার জন্য যা প্রয়োজন, তা হলো সংবিধান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সে প্রত্যাশা পূরণ করেন। কেননা, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান গঠন করা। তাই নির্বাচনে জয়লাভের পর সরকার গঠনের অব্যবহিত পরই আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান প্রণয়নের কর্মসূচিতে হাত দেন। তারপর ১৯৭২ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সংবিধান বলবৎ ও কার্যকরী হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধতা প্রমাণিত হয় এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণমূলক মনোভাব ধরা পড়ে। তাই বাঙালি জাতির স্বাধিকার আদায়ের জন্য নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ সরকারকে বানচাল করার জন্য ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এবং ১ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। ফলে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটায়। তাই বলা যায়, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথকে প্রসারিত করে তোলে।