অথবা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনি ফলাফল মেনে নিতে কেন্দ্রীয় সরকার কেন আপত্তি জানিয়েছিল? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৫৪ সালের নির্বাচনই ছিল বেশি অবাধ ও নিরপেক্ষ এজন্য এ নির্বাচন ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পিছনে বিভিন্ন দিক থেকে এ নির্বাচন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনের এ ফলাফলে পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা ভীত ও স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তারা নানা রকম অপকৌশল ও কূটকৌশল অবলম্বন করতে থাকে। নানা অজুহাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপণ করতে থাকে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনি ফলাফলে কেন্দ্রের অস্বীকৃতি জানানোর কারণ : আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে মহিলা সংরক্ষিত আসন ৭টি সহ ১৬৭টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা
অর্জন করে। অন্যদিকে, প্রাদেশিক পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে মোট ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত ১০টি মহিলা আসনসহ মোট ২৯৮টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
১. ক্ষমতা হারানোর ভীতি : পাকিস্তানের সামরিক সরকার নির্বাচনি ফলাফলে হতভম্ভ হয়ে পড়ে। পাকিস্তান সরকার তাদের এমন ভরাডুবি কখনো ভাবেনি। ফলে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে ক্ষমতা হারাতে তারা চায়নি। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার কখনো পূর্ব পাকিস্তানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর চায়নি। তারা মনে করে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের হাতে চলে গেলে যাবতীয় সবকিছু পশ্চিম পাকিস্তানের বাহিরে চলে যাবে। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা খর্ব হবে এবং নীতি নির্ধারণে তাদের তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে না এজন্য সামরিক জান্তা ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে।
২. শাসন শোষণের অবসান : ১৯৪৭ সালে দুটি প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সুপরিকল্পিতভাবে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে। তাদের বৈষম্য অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট প্রদান করে। ফলে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে তাদের শাসন ও শোষণের অবসান ঘটবে এ ভয়ে তারা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়।
৩. জাতীয় ঐতিহ্য ও গৌরব রক্ষা : পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের নিম্নশ্রেণি বলে মনে করতো। অন্যদিকে, পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি বিশেষ করে পাঞ্জাব প্রদেশের লোকেরা নিজেদেরকে উচ্চ শ্রেণি মনে করতো। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক সরকার ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মনে করেছিল তাদের কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছে এমন শোচনীয় পরাজয় পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঐতিহ্য ও গৌরবকে ধ্বংস করেছিল। যার
কারণে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়।
৪. ক্ষমতা কুক্ষিগত করা : নির্বাচনি ফলাফলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী হতাশ হয়ে পড়ে। ইয়াহিয়া চেয়েছিল যে কোনোভাবে ক্ষমতা কুক্ষীগত রাখতে এবং ভুট্টো চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগকে দূরে সরিয়ে রেখে যেকোনো মূল্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করতে। অপরদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ক্ষমতার বৈধ দাবিদার। এজন্য পাকিস্তান বাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে।
৫. পাকিস্তান পিপলস পার্টির ষড়যন্ত্র : ১৯৭০ সালের নির্বাচনি ফলাফল জটিল আকার ধারণ করে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠত
া লাভ করে। অন্যদিকে,
পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করবে কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি করেন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধি। তিনি আওয়ামী লীগের ছয়দফা দাবি মানতে রাজী নন। ফলে শাসনতান্ত্রিভাবে এর অচল অবস্থা সৃষ্টি হয়। সামরিক শাসক ও জুলফিকার আলী ভুট্টো কোনোক্রমেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হয়নি। তারা ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে নীলনকশা তৈরি করে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়।
৬. সামরিক শাসকের হস্তক্ষেপ : ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা৷ হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু বিজয়ী আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তিনি তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। সামরিক সরকার কখনো চায়নি পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের হাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা থাকুক। কাজেই সামরিক সরকার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে বদ্ধপরিকর হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল ও সামরিক সরকার মিলে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে টালবাহানা শুরু করে এবং তাদের লক্ষ্য ছিল পুনরায় সামরিক শাসন বলবৎ করা।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত হতো পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা। পশ্চিম পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানিদের তাদের সমকক্ষ মনে করতো না। তারা নানা রকম বৈষম্য, নির্যাতন ও শোষণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে দমন করে রাখতো। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায় এবং নানা রকম টালবাহানা শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। অসহযোগ আন্দোলন দমন করার জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করে । পরবর্তীতে পূর্ব বাংলার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সৃষ্টি হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।