অথবা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনি ফলাফল বিশ্লেষণ কর। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ বর্ণনা কর।
অথবা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব বর্ণনা কর। এ নির্বাচনে আওয়ীী লীগের বিজয়ের কারণ কী ছিল?
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির অগ্রদূত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পাকিস্তানের বিভক্তি সুনিশ্চিত। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য ও বৈপরীত্য বিরাজমান, যার ফলে এ দুটি প্রদেশ একসাথে চলতে পারা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল এর ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের কর্তৃত্ব ও বৈধতা হারায়। নির্বাচনি ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে ৭টিসহ মোট ১৬৭টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আর পিপলস পার্টি ৫টি সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ মোট ৮৮টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। আবার পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে মোট ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত মহিলা আসন সহ মোট ২৯৮টি আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আওয়ামী লীগ যেমন পশ্চিমাঞ্চলে একটি আসনও পায়নি তেমনি পিপিপি পূর্বাঞ্চলে একটি আসনও পায়নি। নির্বাচনি এরূপ ফলাফল পূর্ব পাকিস্তানকে একটি পৃথক অঞ্চল এবং বাঙালি জাতিকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং এ অঞ্চলের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হস্তক্ষেপকে অবৈধ বলে প্রমাণ করেছে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব সাফল্য লাভের পিছনে কতকগুলো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যথা :
র্বাচনি ইশতেহার : আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার ছিল পূর্ব বাংলার গণমানুষের ইশতেহার। আওয়ামী লীগের ছয়দফাভিত্তিক ইশতেহার এ অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবি এবং নির্বাচনের পূর্বেই এসব দাবি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ফলে নির্বাচনে জনসাধারণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে মূলত তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে।
২. শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ : পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিমাঞ্চলের শাসকবর্গ নানা উপায়ে পূর্বাঞ্চলকে শোষণ করেছে। এ শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। তাই নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের দলগুলোকে পূর্ব বাংলার জন্য প্রত্যাখ্যান করে তারা প্রতিশোধ আদায় করেছে।
৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মোহনী নেতৃত্ব : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মোহনী নেতৃত্বের ফলে সমগ্র পূর্ব বাংলার জনতার সমর্থন লাভ করেন। নির্বাচনি প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামি আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে এ অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ মানুষের সমর্থন লাভ করেন।
৪. পাকিস্তান সরকার দুর্যোগ প্রতিরোধে ব্যর্থ : ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের বন্যায় এ অঞ্চলে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। পাকিস্তানের শাসকবর্গ এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্যার্ত মানুষের সুখ, দুঃখ, দুর্দশা ও সরকারের ব্যর্থতা প্রচার করে নির্বাচনি সাফল্য অর্জন করেন।
৫. ভুট্টোর জনবিরোধী ভূমিকা : ভুট্টো এক ইউনিটের কথা ঘোষণা করে পাঞ্জাবিদের নিকট জনপ্রিয়তা পেল ও পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের নিকট বিরাগভাজন হন।
৬. নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার : ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের প্রতি অনুগত না হয়েও ইসলামি সমাজতন্ত্রের কথা প্রচার করে ভুট্টো পাকিস্তানি ইসলাম পন্থিদের সমর্থন পাননি। অপরদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে উল্লেখযোগ্য ভোটার ছিল অমুসলমান। যারা ভুট্টোর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগে ভোট প্রদান করে।
৭. বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রভাব : পাকিস্তান সরকার শুরু থেকে পূর্ব বাংলার উপর ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ শুরু করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে তা ‘৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে কাজ করেছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আরো সুদৃঢ় করে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকবর্গ আওয়ামী লীগের বিজয়কে প্রত্যাখ্যান করলে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। তাই বলা যায়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল।