১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের উপর একটি প্রবন্ধ লিখ।
অথবা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রাচীনকাল থেকে বাংলা ছিল কাব্যে উপেক্ষার মতো। বাংলার জনগণ আদিকাল থেকে শোষিত হয়েছে। শাসন করার কথা ভাবতেও পারেনি। প্রাচীনকালে শশাঙ্ক কিছুটা এ নিয়মের ব্যতিক্রম করেছিলেন। এভাবে আমরা আধুনিক কালের ইতিহাসে দেখি যে, বাংলা প্রায় দুইশত বছর ব্রিটিশ শাসনে শোষিত ও নির্যাতিত হয়। বহু
ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আন্দোলনের ফলে ১৯৪৭ সালে বাংলা ব্রিটিশ অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পায়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ব্রিটিশ শাসন শোষণ থেকে মুক্তি পেলেও আবার পশ্চিমা প্রতিক্রিয়াশীল শাসক গোষ্ঠীর শোষণে পতিত হয়। পশ্চিমা শোষণে বাংলার জনসাধারণের ক্ষোভের কারণে ঘটনা পরিক্রমায় সংঘটিত হয় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান।১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট : আমরা ইতিহাসের কার্যকারণ তত্ত্ব আলোচনায় দেখেছি যে, প্রতিটি ঘটনার জন্য কারণের উপস্থিতি ছিল। তাই ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের জন্যও একাধিক বিষয়
আলোচনা করা দরকার। নিম্নে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সাথে জড়িত বিষয়াদির বিবরণ দেয়া হলো :
১. ছয়দফার প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব : ২১ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা কর্মসূচি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অনুমোদন লাভ করে। ৬ দফা কর্মসূচি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানি নেতারা শংকিত হয়ে পড়েন। দক্ষিণপন্থি দলগুলোও এর অপব্যাখ্যা করে আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিহ্নিত করেন। এ ৬ দফা আন্দোলনকে
দমন করার জন্য পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন পন্থা গ্রহণ করেন।
২. পাকিস্তানি রাজনীতির বৈশিষ্ট্য : পাকিস্তানের রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, দেশের অর্থনৈতিক তৎপরতার পশ্চাতে সামরিক চক্রের অদৃশ্য খেলা সর্বদাই সক্রিয় ছিল। এ কারণেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের প্রবেশ ঘটতে পারেনি। ফলে অসাম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য করার মতো সাধ্য কারও ছিল না। তথাপি বাধ্যবাধকতার বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ.কে. ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানি শাসক চক্রের সৃষ্ট পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। বহুবার বাংলার এসব নেতাদেরকে মিথ্যা মামলা ও দেশদ্রোহিতার অপরাধে কারাবদ্ধ করা হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও দেশপ্রেমিক বাঙালিদেরকে দাবিয়ে রাখা যায়নি।
৩. ৬ দফা আন্দোলনকে চিরতরে দমন : পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ৬ দফা আন্দোলনকে দমন করার জন্য নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর প্রতিবাদে ৭ জুন সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। দেশের সর্বত্র নাগরিক জীবন স্তব্ধ হয়ে পড়ে।
৪. ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মধ্যে ভাঙন : জাতি যখন ৬ দফা পরবর্তী সংকটে পড়ে, তখন ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ এর মধ্যে বিভক্তি দেখা যায়। এর এক দলের নেতা মওলানা ভাসানী। অন্য দলের নেতা পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়ালি খান। ওয়ালি খান রানিয়ার সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। পূর্ব পাকিস্তানে ওয়ালি ন্যাপের নেতা ছিলেন অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ। মুজাফফর আহমদ ৬ দফাকে সমর্থন করেন। কিন্তু ভাসানী পন্থিরা বিরোধিতা করেন। ফলে ৬ দফা আন্দোলন
দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।
৫. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা : পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। এ সময় স্বৈরাচারী সরকার দেশদ্রোহিতার অজুহাতে শেখ মুজিবকে প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।য়অতঃপর শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে কুমিল্লা সেনানিবাসে আটক রাখেন।
৬. আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ : ১৯৬৮ সাল থেকে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দেয়। ১৯৬৪ সালের পর থেকে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে, তা আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে একজন ছাত্র হত্যাকে কেন্দ্র করে এ পুঞ্জীভূত অসন্তোষের আগুন জ্বলে উঠে। তরুণ ও ছাত্রসমাজ
আইয়ুব সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলনের আওয়াজ তোলেন।
৭. উন্নয়ন দর্শক উদযাপন : ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান তার শাসনকালকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য উন্নয়ন দর্শক উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ উৎসব পালনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যে, জনগণ এতে অংশগ্রহণ করেনি। সাধারণত মনে করা হয় যে, উন্নয়ন দর্শকের অপচয় এ সরকারের পতনকে আসন্ন করে তুলেছিল। জনগণের টাকা খরচ করে
সরকারের পক্ষে ঢাকঢোল পিটানোর কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজমান ছিল, তা বিবেচনা করে পাকিস্তানিরা এতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
৮. গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন : দীর্ঘদিন থেকে পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক শাসন পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু জনগণের দাবি তারা সম্মিলিতভাবে পেশ করতে পারেনি বলে সফলকাম হয়নি। ১৯৬৯ সালে ৮ জানুয়ারি অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ ঢাকাতে মিলিত হয়ে একটি
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ন্যাপ ও পিপলস্ পার্টি ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল ৮ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের ঐক্য জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায়।
৯. ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন : গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পূর্বে পাকিস্তানের ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একাংশ নিয়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় (১৯৬৯/৬ জানুয়ারি)। দেশে যখন নেতৃত্বের অভাব, তখন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবসহ
অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী যে গণআন্দোলন শুরু হয়, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ তাদের ১১ দফার ভিত্তিতে সে আন্দোলনে শরীক হয় এবং একে জোরদার করে তোলেন।১০. ১১ দফা কর্মসূচি : ১১ দফা কর্মসূচিকে বলা হয় আন্দোলনের প্রাথমিক সুতিকাগার। ১১ দফার মধ্যে ৬ দফা কর্মসূচিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণার ফলে আন্দোলন আরো বলিষ্ঠ হয়। ১১ দফা কর্মসূচিতে
বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিলসহ শিক্ষা সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারসহ বাক
স্বাধীনতা, বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ, কৃষক শ্রমিকের সুযোগ সুবিধা নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, জরুরি নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার ও রাজবন্দীদের মুক্তি প্রভৃতি দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১১. গণআন্দোলনে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা : মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রথম ছাত্রদের ১১ দফার প্রতি সমর্থন জানান। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যখন জেলে, তখন তারই নেতৃত্বে শুরু হয় গণআন্দোলন। তার আহ্বানে ডিসেম্বরের শুরুতে পর পর তিনদিন হরতাল শুরু হয় এবং জনসভা ও মিছিলগুলো গণআন্দোলনের রূপ ধারণ করে।
১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি জুলুম প্রতিরোধ দিবসের আহ্বান জানান এবং পল্টনের জনসভার পর গভর্নর হাউস ঘেরাও করেন। ২৯ ডিসেম্বর তিনি পাবনার বিশাল জনসভায় নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানান। এ সভার পরই ডিসির বাড়ি ঘেরাও করার মাধ্যমে মওলানা ভাসানী ঘেরাও আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি পল্টনের
জনসভায় ঘোষণা করেন যে, প্রয়োজন হলে ফরাসি বিপ্লবের ন্যায় জেলখানা ভেঙে শেখ মুজিবকে নিয়ে আসব। ১৯৬৯ সালের আন্দোলন সারা দেশের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কলকারখানায়, গ্রামেগঞ্জে ঘেরাও ধর্মঘট অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে।
১২. পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের মৃত্যু : গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সাথে সাথে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নতুন প্রেরণা লাভ করে। সর্বশ্রেণির লোক ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষাবিদ শিল্পী প্রত্যেকেই এ আন্দোলনে যোগদান করে। স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে ‘ডাক’ কর্তৃক আহূত হরতাল (১৭
জানুয়ারি/১৯৬৯) সম্পূর্ণ সফল হয় এবং এ আন্দোলনের পশ্চাতে যে জনগণের সমর্থন আছে, তা প্রমাণিত হয়। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামানের নিহত হওয়ার সাথে সাথে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান সংগ্রামী মনোভাব নিয়ে আন্দোলনে যোগদান করেন এবং তা গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। পুলিশ কর্তৃক ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সমগ্র প্রদেশে ধর্মঘট মিছিল চলতে থাকে। এটা কয়েকদিন চলে এবং অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য অনেক
জায়গায় ‘কারফিউ জারি করতে হয়।
১৩. জহরুল হক ও ড. সামসুজ্জোহার মৃত্যু সমগ্র দেশব্যাপী যখন আন্দোলন তুঙ্গে, তখন দুটি ঘটনা পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহরুল হককে ক্যান্টনমেন্টে গুলি করে হত্যা (১৫ ফেব্রুয়ারি/১৯৬৯) এবং পুলিশের গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের রিডার ড.
সামসুজ্জোহার মৃত্যু (১৭ ফেব্রুয়ারি/১৯৬৯) সারা দেশে বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট আন্দোলনের প্রচণ্ডতা লক্ষ্য করে আইয়ুব খান ২১ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ ঘোষণা করেন যে, আগামী নির্বাচনে তিনি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হবেন না। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে শান্ত করার জন্য তিনি গভর্নর মোনেম খানকে বরখাস্ত করে তদস্থলে ড. এম. এন
হুদাকে নিয়োগ করেন। উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, গণঅভ্যুত্থানের শুরুটা হয়েছিল মূলত ১৯৬৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব
সরকারের পাকিস্তানের উন্নয়ন দশক পালনের মধ্য দিয়ে। এর চরম রূপলাভ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও আইয়ুব করকারের পতনের মধ্য দিয়ে।