অথবা, ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট লিখ।
উত্তরা৷ ভূমিকা : আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। সামরিক শাসক আইয়ুব ক্ষমতা দখলের পর একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি তৎকালীন শিক্ষা সচিব ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. এস. এম. শরীফকে চেয়ারম্যান করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করেন। এটি শরীফ শিক্ষা কমিশন নামে খ্যাত। চলমান আইয়ুব সরকারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন সংযোজিত বিষয়, যা বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন নামে খ্যাত।
শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট : শরীফ কমিশন যে শিক্ষানীতি বা শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন ধারা সংযোজন করে নিচে তা আলোচনা করা হলো :
i. পাস কোর্স চালু : ১৯৬২ সালের শরীফ শিক্ষা কমিশনে শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন সংযোজন দাঁড় করায়। ১৯৬২ সালের ৫ কমিশন রিপোর্টে তিন বছরের বি. এ. পাস কোর্স পদ্ধতি চালু করা হয়।
ii. স্কুল কলেজ সীমিতকরণ : স্বৈরাচারী আইয়ুব খান সরকার জাতিকে শিক্ষা থেকে দূরে সরে রাখতে স্কুল-কলেজ সীমিতকরণ করেছিল। এতে অনেক ছাত্র শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। শরীফ কমিশনে বলা হয়, স্কুল-কলেজের সংখ্যা সীমিত রাখা, শিক্ষা ব্যয়ের শতকরা ৮০ ভাগ অভিভাবক এবং বাকি ২০ ভাগ সরকার কর্তৃক বহন করা।
iii. ইংরেজি বাধ্যতামূলক : আইয়ুব খান ব্রিটিশ সামরিকবাহিনীতে কর্মরত ছিল আবার ঐখান থেকে তিনি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন । এজন্য আইয়ুব খান ইংরেজির প্রতি অনুরপ্ত ছিলেন। তাই শরীফ কমিশনে ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা হয়।
iv. উর্দুকে জনগণের ভাষা : শরীফ কমিশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু ভাষাকে স্থান দেয়া হয় এতে বাংলাকে উপেক্ষা করা হয় ও উর্দুকে জনগণের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালায়।
v. আরবি বর্ণমালা : আইয়ুব খান কর্তৃক শরীফ কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী জাতীয় ভাষার জন্য একটি সাধারণ বর্ণমালা প্রবর্তনের চেষ্টা করা এবং সেক্ষেত্রে আরবিকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়।
vi. ভাষান্তর : শরীফ কমিশনে কখনো বাংলা ও উর্দুকে আরবি হরফে লেখা আবার কখনো রোমান বর্ণমালার সাহায্যে পাকিস্তানি ভাষাসমূহকে অক্ষারান্তরের প্রচেষ্টা।
vii. শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি : শরীফ কমিশনের রিপোর্টে অস্থায়ী স্কুল-কলেজের সংখ্যা সীমিতকরণ ও শিক্ষার ব্যয় ৮০% অভিভাবক ও ২০% সরকারিভাবে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে শিক্ষা ব্যয় বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। শিক্ষাক্ষেত্র বাণিজ্যিক অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়ে উঠে। এতে ছাত্রসমাজ আইয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে ।
vili. অবাস্তব পরিকল্পনা : ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট অবৈতনিক শিক্ষার ধারণাকে অবাস্তব পরিকল্পনা বলে উল্লেখ করা হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ শিক্ষার্থী হতাশায় ভোগে ও ছাত্রজীবনের ইতি টানে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে ছাত্রসমাজ গণবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল, শিক্ষা সংকোচন, শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে গণ্য করা; বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করে। এ রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা ব্যাপক প্রচারণা, সভা, সমাবেশ, মিছিল, ধর্মঘট চালিয়ে যেতে থাকে। ক্রমে এ আন্দোলন সমগ্র প্রদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।