১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের কারণ

১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের মূল কারণ ছিল তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান কর্তৃক গঠিত শরীফ কমিশন-এর প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি। এটিকে ‘শিক্ষা আন্দোলন’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

এই কমিশনের প্রতিবেদনে এমন কিছু প্রস্তাবনা ছিল যা পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ছাত্র ও সাধারণ জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল বলে মনে করা হয়েছিল। প্রধান কারণগুলো নিম্নরূপ:

১. শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি: কমিশনের রিপোর্টে শিক্ষাকে ‘পণ্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করে শিক্ষার ব্যয়ভার বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, “আমাদের শিক্ষা সম্পর্কে জনগণের ঐতিহ্যগত চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করতে হবে। তারা মনে করে যে শিক্ষা একটি সস্তা জিনিস যা পরিবর্তন করা উচিত। আমাদের সত্যটি মনে রাখতে হবে যে উচ্চ মানের পণ্যের উচ্চ মূল্য রয়েছে।” এর ফলে দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
২. উচ্চশিক্ষা সংকোচন: উচ্চশিক্ষার সুযোগ কমানোর জন্য ডিগ্রি কোর্সের মেয়াদ দুই বছর থেকে বাড়িয়ে তিন বছর করার প্রস্তাব করা হয়।

  1. বাধ্যতামূলক বিষয়: রিপোর্টে ইংরেজি এবং উর্দুকে বাধ্যতামূলক বিষয় করার সুপারিশ করা হয়।
  2. বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার বাতিল: বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার অধিকারকে ‘অবাস্তব ইউটোপিয়ান’ বলে বাতিল করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
  3. শিক্ষকদের কর্মঘণ্টা বৃদ্ধি: শিক্ষকদের জন্য দৈনিক ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিল।
  4. রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণ: এই আন্দোলন শুধুমাত্র শিক্ষাসংক্রান্ত দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল মূলত সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের দমনমূলক শাসন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্য, এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাতের (যেমন রবীন্দ্র সঙ্গীত ও বর্ণমালা সংস্কারের প্রস্তাব) বিরুদ্ধে বৃহত্তর স্বাধিকার আন্দোলনেরই অংশ।

সামরিক আইন প্রত্যাহার হওয়ার পর ১৯৬২ সালে এই শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে এবং এই আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৭ সেপ্টেম্বর, যেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় এবং ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ কয়েকজন শহীদ হন। এই দিনটি বাংলাদেশে ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এই আন্দোলনের ফলে সরকার শেষ পর্যন্ত শরীফ কমিশনের রিপোর্টের বাস্তবায়ন স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল।