১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব বাংলায় কী ধরনের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বর্ণনা কর

অথবা, পাকিস্তানে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব বাংলায় কী ধরনের রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম লীগ সর্বশ্রেণির জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই এ দলটির ক্ষমতাসীন নেতৃবৃন্দ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের পন্থা হিসেবে দলীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে আস্তে আস্তে এ দলে গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেতে থাকে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানে কতিপয় মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী মনোভাব এবং গণস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপই পাকিস্তানের রাজনীতিতে শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দল সৃষ্টির পথকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল ।
১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ : পূর্ব পাকিস্তানে স্বৈরাচারী মুসলিম লীগ বিরোধী দল গড়ে উঠে। নিচে দলগুলোর উৎপত্তি ও বিকাশ আলোচনা করা হলো :
১. আওয়ামী মুসলিম লীগ : আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। এ দলের প্রতিষ্ঠাতাগণের প্রায় সকলেই ছিলেন মুসলিম লীগের সাথে সম্পৃক্ত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর থেকেই বিভিন্ন প্রশ্নে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মুসলিম নেতৃবৃন্দের জনবিরোধী কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল তরুন সম্প্রদায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ
গার্ডেনে প্রায় ৩০০ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে। এ দলের সভাপতি নির্বাচিত হন
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৪৯ সালের ২৪ জুন মুসলিম লীগের হুমকি উপেক্ষা করে এ দলের প্রকাশ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে। আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন, ভাষা
অন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আওয়ামী মুসলিম লীগের অনুসারী পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগের জোরালো ভূমিকা ভাষা আন্দোলনকে গতিশীল করে। ১৯৫৫ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয় এবং আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়। ১৯৫৬-৫৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
নিযুক্ত হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের ফলে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ‘৬২ সালে আবার কার্যক্রম শুরু হলে সরকারবিরোধী দলগুলোর সমন্বয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হয়। পুনরায় ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে
দল পুনর্গঠিত হয় এবং প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
২. কৃষক শ্রমিক পার্টি : বাংলার কৃষক দরদি নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের রাজনৈতিক দলের নাম ছিল কৃষক শ্রমিক পার্টি। তিনি প্রথমে যদিও মুসলিম লীগের সাথে জড়িত ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে আলাদা দল গঠন করেন। তার দল ছিল পূর্ব বাংলার কৃষক শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণে সোচ্চার।
কৃষক শ্রমিক পার্টি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের সাথে যুক্ত হয়ে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
৩. জামায়াতে ইসলামি : জামায়াতে ইসলামি হচ্ছে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি পুরাতন রাজনৈতিক দল। অবিভক্ত ভারতে ১৯৪১ সালে ২৬ আগস্ট মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ‘জামায়াতে ইসলামি হিন্দ’ নামে এ দলটি আত্মপ্রকাশ করে। দলটি প্রথমে ভারত বিভক্তির বিরোধিতা করলেও পরবর্তীতে তা মেনে নেয়। দেশ বিভক্তির পর
দলটি ‘জামায়াতে ইসলামি’ দল নামে তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানে এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫১ সালে। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে দলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৬৯-৭০ সালে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন এবং সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে এ দলের ভূমিকা ছিল আক্রমণাত্মক।
৪. নেজামে ইসলামি : মাওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বে গঠিত নেজামে ইসলামি ছিল একটি ধর্মীয় রক্ষণশীল দল। সাধারণ জনগণের কাছে এ দলটির তেমন কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তাই তারা অন্যান্য বিরোধী দল যথা :
আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি প্রভৃতি দলের সাথে একত্রিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এ দলটি ধর্মীয় গোঁড়ামি জামায়েতে ইসলামির মতো এতটা কট্টর ছিল না। এ দল জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টেরও সদস্য ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে এ দলের নেতা ছিলেন ফরিদ আহমদ চৌধুরী।
৫. পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি : ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অংশ হিসেবে কাজ করত। এ দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী ছিল হিন্দু। তাই মুসলিম লীগ সরকার এদের বিরুদ্ধে দমননীতি গ্রহণ করে। ১৯৫১-১৯৫২ সালে এ দলটি সহিংস বিপ্লবের পথ থেকে সরে আসে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এ দলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ দলটি ছিল প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক। ১৯৫৪ সালের ২৩ জুলাই সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে এ দলটি ভেঙে যায় এবং অনেক কমিউনিস্ট নেতা আওয়ামী লীগ ও পরে ন্যাপে যোগ দেয়।
পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস : পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস পূর্ব বাংলার আইনসভা এবং পাকিস্তান গণপরিষদে বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করতে থাকে। তবে কংগ্রেস ছিল হিন্দু নেতৃত্ব দ্বারা প্রভাবিত। তাই কংগ্রেস হিন্দুদের স্বার্থ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকত। দলটি পাকিস্তানের শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলন তথা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ দলটিকে মুসলিম লীগ সরকার ভারতের দালাল, গুপ্তচর প্রভৃতি বলে
দমননিপীড়ন অব্যাহত রাখে। ফলে পূর্ব বাংলায় দলটি আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
গণতন্ত্রী দল : ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বে ‘গণতন্ত্রী দল’ নামে একটি অসম্প্রদায়িক দল গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে এ দল প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে যুক্তফ্রন্টের সাথে একত্রিত হয়। এ দলের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক সমাজ।
ন্যাশনাল পার্টি : ন্যাশনাল পার্টি ছিল একটি বামপন্থি সংগঠন। এ দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে মিয়া ইফতেখার উদ্দিন, আব্দুল গাফফার খান, জি.এম. সৈয়দ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এ দল পরবর্তীতে গণতন্ত্রী দল ও মওলানা ভাসানীর সমর্থকদের সাথে একত্রিত হয়ে যায়।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) : আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই ঢাকায় এক সম্মেলনে গণতন্ত্রী দল ও ন্যাশনাল পার্টির সমর্থকদের সমন্বয়ে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। মওলানা ভাসানী এ দলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন
পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী। ১৯৬৭ সালে এ দলের কিছু সমর্থকদের মধ্যে আদর্শগত বিরোধ দেখা দেয় এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । এ দলটি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবির পক্ষে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) : ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করা নেতাদের মধ্যে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছিলেন অন্যতম। মওলানা ভাসানীর সাথে তার চীনা কমিউনিস্ট ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতবাদ নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তার সমর্থকদের নিয়ে আলাদা দল গঠন করেন। ন্যাপ মোজাফফর আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে সমর্থন দান করে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় এ দলটি গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদের সাথে একত্রে কাজ করে এবং ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচিতে সমর্থন দান করে।
খিলাফতে রব্বানী পার্টি : ১৯৫২ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি খিলাফতে রব্বানী পার্টি গঠিত হয়। শোষণহীন ইসলামি সমাজ জীবন কায়েম করা এ পার্টির একান্ত এবং প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।