১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইনে গঠিত লোকাল বোর্ডের বর্ণনা দাও।

অথবা, ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইনে গঠিত লোকাল বোর্ড সম্পর্কে যা যান লিখ।
অথবা, ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় স্বায়ত্তশাসন আইনে গঠিত লোকাল বোর্ড সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় স্বায়ত্তশাসন আইনে গঠিত লোকাল বোর্ড সম্পর্কে বিস্তারিত লিখ।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : বাংলাদেশে বর্তমানে আমরা যে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থা দেখতে পাই। তা একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিভিন্ন ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে তা আজকের রূপ পেয়েছে। ব্রিটিশরা ক্ষমতা দখলের পূর্বে
প্রাচীন বাংলার গ্রামগুলো অনেকটা স্বাধীনভাবে তাদের প্রশাসন পরিচালনা করতো।
১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইনে গঠিত লোকাল বোর্ড : ব্রিটিশপূর্ব ভারতবর্ষে স্বশাসিত স্থানীয় শাসন থাকলেও ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে শাসনভার গ্রহণ করার সাথে সাথে তা পরিবর্তন হতে থাকে।
ঔপনিবেশিক শাসন স্থায়ী করার জন্য তারা প্রথমেই ঐতিহ্যগত স্বায়ত্তশাসিত গ্রাম সরকারের উপর আঘাত হানে। ১৭৯৩
সালে স্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের দ্বারা ব্রিটিশ সরকার জমিদার প্রথা চালু করে ইচ্ছাকৃতভাবে পূর্বতন স্বায়ত্তশাসিত গ্রাম
সরকারের উপর আক্রমণ করে। জমিদাররা তাদের সামন্তবাদী চরিত্রের জন্য গ্রামবাসীকে শোষণ করে স্বায়ত্তশাসিত গ্রামগুলোকে বিলুপ্ত করেছিল। নিম্ন পর্যায়ের প্রশাসনে এবং নিজেদের জীবন প্রণালিতে জনগণের নিয়ন্ত্রণের অধিকার নিঃশেষিত হওয়ায় ব্রিটিশ শাসনে স্থানীয় সরকার ধ্বংস হয়ে যায়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের পরপরই কোম্পানি
শাসনের অবসান ঘটে এবং ১৮৫৮ সাল থেকে ইংরেজরা ভারতবর্ষ শাসনের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ করে। সিপাহি বিপ্লবের পর ইংরেজ সরকার অনুভব করেন এদেশ শাসন করতে হলে শুধু শোষণ নয় স্থানীয় এলাকার উন্নতি সাধনের নীতি গ্রহণ করতে হবে। প্রাচীন গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গৌরব হারিয়ে ফেলার ফলে ব্রিটিশ সরকার তাদের শাসন আমলে স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কতগুলো আইন পাস করেন যার মধ্যে বঙ্গীয় স্বায়ত্তশাসন আইন, ১৮৮৫ খুবই
গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন। এই আইনের মাধ্যমে তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার গঠন করা হয়। স্তর গুলো হলো :
ক. জেলা পর্যায়ে : জেলা বোর্ড, যার সদস্য সংখ্যা ছিল ৯ জন।
খ. মহকুমা পর্যায়ে : লোকাল বোর্ড, যার সদস্য সংখ্যা ছিল ৬ জন।
গ. ইউনিয়ন পর্যায়ে : ইউনিয়ন কমিটি, যার সদস্য সংখ্যা ছিল ৫-৯ জন।
বঙ্গীয় স্বায়ত্তশাসন ১৮৮৫ অনুযায়ী মহকুমা পর্যায়ে যে লোকাল বোর্ড গঠনের কথা উল্লেখ রয়েছে। উক্ত লোকাল বোর্ডের গঠন প্রক্রিয়া নিম্নে আলোচনা করা হলো :
লোকাল বোর্ড (Local board): ১৮৮৫ সালে সর্বপ্রথম লোকাল বোর্ড গঠনের মাধ্যমে মহকুমা পর্যায়ে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে গোড়াপত্তন হয়। এতে লোকাল বোর্ড ক্রার্যক্রম অনেকটা ইউনিয়ন কমিটির মতো কাজ করে, কারণ লোকাল বোর্ডের ক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত। লোকাল বোর্ডের সদস্য সংখ্যা কত হবে তা সরকার নির্ধারণ করে দিতেন। তবে এর সংখ্যা ৬ এর কম নয় এবং ৩০ এর বেশি নয়, এর মধ্যে রাখা হতো। মহকুমার অধীনে প্রতি থানা থেকে একজন লোকাল বোর্ডের সদস্য ছিলেন। লোকাল বোর্ডে সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। বোর্ডের সদস্য যত হবেন এর দুই তৃতীয়াংশ । সদস্য ভোটাধিকারের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত এবং এক তৃতীয়াংশ সরকার কর্তৃক মনোনীত হতেন।
নিম্নোক্ত কারণে লোকাল বোর্ডের সদস্যপদ বাতিল হতে পারত । যথা :
ক. বোর্ডের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যে কোন সদস্যকে অপসারণ করতে পারবে।
খ. ফৌজদারি অপরাধজনিত কারণে স্থানীয় সরকার যে কোন সদস্যকে যে কোন সময় অপসারণ করতে পারবে।
গ. কোন সদস্য মারা গেলে, পদত্যাগ করলে, শপথ গ্রহণে ব্যর্থ হলে কিংবা অপসারিত হলে তার সদস্যপদ শূন্য হবে।
ঘ. কমিশনার স্বীয় ক্ষমতাবলে যে কোন সদস্যকে অপসারণ করতে পারবেন।
চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান : লোকাল বোর্ডের একজন চেয়ারম্যান ছিলেন। চেয়ারম্যান বোর্ডের সদস্যদের মধ্য থেকে বোর্ডের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন। বোর্ডের গঠনের এক মাসের মধ্যে চেয়ারম্যান নির্বাচন করার নিয়ম ছিল। কিন্তু কোন কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে না পারলে কমিশনার চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে পারতেন। চেয়ারম্যান দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে কমিশনারের অনুমোদন গ্রহণ করতেন। চেয়ারম্যান ছাড়াও লোকাল বোর্ডে একজন ভাইস চেয়ারম্যান থাকতেন। ভাইস চেয়ারম্যান বোর্ডের সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হতেন। তবে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে কমিশনার, ভাইস চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে পারতেন। কমিশনার স্বক্ষমতা বলে অপসারণও করতে পারতেন। ভাইস চেয়ারম্যান মূলত চেয়ারম্যান নির্দেশিত দায়িত্ব পালন করতেন। কোন কারণে চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে তিনি তারও দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। মৃত্যু, অপসারণ কিংবা
পদত্যাগজনিত কারণে চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ না পাওয়া পর্যন্ত ভাইস চেয়ারম্যান তার দায়িত্বও পালন করতেন ।
কার্যক্রম : লোকাল বোর্ড মূলত কিছু জনকল্যাণকর দায়িত্ব সম্পাদন করতো। যেমন- ব্রিজ, কালভার্ট মেরামত ও সংরক্ষণ, কাঁচারাস্তা তৈরি ও সংস্কার, প্রাইমারি স্কুল, মক্তব, টোল ইত্যাদি সবকিছুর জন্য জেলা বোর্ড যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করতো তা দিয়েই সম্পন্ন করতে হতো। আর্থিক দিক দিয়ে লোকাল বোর্ডের স্বাধীনতা ছিল না বললেই চলে । নিজস্ব তহবিল সংগ্রহের জন্য লোকাল বোর্ড কোনরূপ অর্থ সংগ্রহ বা কর ধার্য করতে পারত না। তাছাড়া লোকাল বোর্ডকে জেলা
বোর্ড সরাসরি কোন অর্থ প্রদান করতো না। অর্থ লেনদেন হতো মূলত সরকারি কোষাগারের মাধ্যমে।
ব্যর্থতা : লোকাল বোর্ডের প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মহকুমা প্রশাসক। প্রকৃতপক্ষে তিনি সকল দায়দায়িত্ব পালন করেন। অধিকাংশ লোকাল বোর্ডে মহকুমা প্রশাসকই মনোনীত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন। তার সামনে অন্য কোনো সদস্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারতেন না। সরকারি সদস্য হিসেবে তিনি সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।
অপরদিকে আইনের ধারা অনুসারে ইউনিয়ন বোর্ডের সাথে সরাসরি জেলা বোর্ডের সম্পর্ক স্থাপিত হলে ধীরে ধীরে লোকাল বোর্ডের সকল প্রাধান্য হ্রাস পায়। ১৯১৯ সালের পর ইউনিয়ন বোর্ডের সাথে জেলা বোর্ডের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপিত হলে এটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে এবং ১৯৩৬ সালে বাতিল হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৮৮৫ সালে প্রবর্তিত বঙ্গীয় স্থনীয় স্বায়ত্তশাসন আইন স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ লক্ষ্যে লোকাল বোর্ড গঠন করা হলেও লোকাল বোর্ড জেলা বোর্ডের অবাঞ্ছিত কর্তৃত্বের কারণে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারেনি ।