অথবা, বৌদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায় হিসেবে হীনযান ও মহাযানের পার্থক্য দেখাও।
অথবা, ধর্ম সম্প্রদায় হিসেবে হীনযান ও মহাযানের মধ্যে কী তফাৎ রয়েছে তা সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধধর্মের আদর্শ ও রীতিনীতি নিয়ে তার শিষ্যবর্গের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। প্রাচীনপন্থি গোঁড়া বৌদ্ধগণ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পালনীয় আচার-ব্যবহারেরর কঠোরতা শিথিল করার পক্ষপাতী ছিলেন না এবং যেসব ভিক্ষু এ মতের বিরোধিতা করেছিলেন তাদেরকে প্রাচীনপন্থিরা তাদের সঙ্ঘ থেকে বের করে দেন। কালক্রমে বৌদ্ধধর্মে হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়।
হীনযান ও মহাযানের পার্থক্য : ধর্ম সম্প্রদায় হিসেবে হীনযান ও মহাযানদের আদর্শগত দিক এবং তাত্ত্বিক দিক পর্যালোচনা করলে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় :
১. রক্ষণশীলতা : হীনযান সম্প্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা অত্যন্ত গোঁড়া ও রক্ষণশীল ছিলেন। তারা বৌদ্ধ নির্দেশিত নিয়মকানুন ও আচার ব্যবহার কঠোরভাবে পালনের কথা বলেন কিন্তু মহাযান সম্প্রদায় এত রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন ছিলেন না।
২. ঈশ্বরের অস্তিত্ব : হীনযান সম্প্রদায় ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না কিন্তু মহাযান সম্প্রদায় গৌতম বুদ্ধকে স্বয়ং ঈশ্বররূপে কল্পনা করেন।
৩. কর্মফল ভোগ : হীনযান সম্প্রদায় কর্ম নিয়মে বিশ্বাসী ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন নিজের কর্মফল প্রত্যেককে ভোগ করতে হবে এবং যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ফল ভোগ করবে। কিন্তু মহাযান সম্প্রদায় এ রকম না ভেবে সর্বজনীন মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করার কথা বলেন।
৪. পুনর্জন্ম গ্রহণ : হীনযান মতে, ইহজন্মে যদি নিজ কর্মের ফল ভোগ করা শেষ না হয়, তাহলে তাকে পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু মহাযান সম্প্রদায় পুনর্জন্মের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে কিছু বলেন নি।
৫. কামনা-বাসনা : হীনযানরা জাগতিক কামনা-বাসনা ও ভোগতৃষ্ণা বর্জন করে নৈতিক শুচিতা ও অন্তরে পবিত্রতা সহকারে সংযত জীবনযাপন করার উপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু মহাযান সম্প্রদায় জীবনযাপনে এত কঠোরতার কথা বলেন নি।
৬. নির্বাণ লাভ : হীনযানপন্থিরা মনে করেন, নির্বাণ লাভ করার জন্য ঈশ্বর বা কোন অলৌকিক শক্তির উপর নির্ভর করতে হয় না। কিন্তু মহাযান সম্প্রদায় নির্বাণ লাভের জন্য বুদ্ধরূপ ঈশ্বর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করার কথা বলেন।
৭. বুদ্ধের বাণী : হীনযান সম্প্রদায় গৌতম বুদ্ধের বাণীকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে তা অনুসরণ করেছেন এবং সেভাবেই অনুসরণ করার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু মহাযানরা বুদ্ধের বাণীর অর্থ অনুধাবন করে তা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হীনযান ও মহাযান সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলোর কোনটিরই গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এ উভয় সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদরাই বৌদ্ধধর্মের নীতি, বুদ্ধের বাণী ও উপদেশ সম্পর্কিত মতবাদের ব্যাখ্যা দিয়ে বৌদ্ধধর্মকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন।