উত্তর : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন নিষ্ঠাবান গবেষক ও অন্যতম প্রবন্ধকার রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তাঁর আসল নাম শরত্নাথ ভট্টাচার্য। বাংলা ভাষার প্রাচীন রচনার আবিষ্কর্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতি সর্বাধিক। কেবল প্রাচীন পুঁথির আবিক্রিয়া বা বিস্তৃতপ্রায় মূল্যবান গ্রন্থসমূহের সম্পাদনাই হরপ্রসাদের একমাত্র কর্মকৃতি নয়, বিভিন্ন বিষয়ক মৌলিক প্রবন্ধ-রচয়িতা হিসেবেও বাংলা সাহিত্যে তিনি একটি উল্লেখযোগ্য আসনের অধিকারী হয়েছেন। ন্যায়ধর্মী বিচার-বিশ্লেষণ তাঁর রচিত প্রবন্ধের একটি বিশেষ গুণ। ভারতবর্ষীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি এ অঞ্চলের মানুষের প্রবৃত্তি এবং আন্তজার্তিক চিন্তা-ভাবনা তাঁর প্রবন্ধকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। নামের মধ্য দিয়েই কোনকিছুর সাথে আমাদের প্রাথমিক পরিচয় ঘটে। শিরোনাম হলো শনাক্তকারী প্রতীক। নামের মাধ্যমে ব্যক্তি বস্তু শিল্পকর্ম বা যে-কোন বিষয়ের মৌল বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণও আর্টের অন্তর্ভুক্ত। উৎকৃষ্ট নামকরণ আয়নার মতো শিল্পের মূল উপজীব্য প্রতিফলিত করে। একারণেই সার্থক সাহিত্যকর্মের অন্যতম শর্ত অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ নামকরণ। কবি সাহিত্যিকগণ কাব্যের মূলভাব, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, রূপক বা প্রতীকধর্মিতা, তাঁর জীবনদৃষ্টি প্রভৃতির আলোকে সাহিত্যকর্মের নামকরণ করেন। আমরা তৈল’ প্রবন্ধের নামকরণে সার্থকতা বিচারে এ প্রবন্ধের বিস্তারিত আলোচনার একটি প্রয়াস পাব। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘তৈল’ প্রবন্ধটিতে মনুষ্য সমাজ, তার প্রকৃতি এবং জীবনাচরণের বিভিন্ন রূপ কৌতুকের বাতাবরণে এবং যুক্তিধর্মিতার মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। প্রবন্ধের শুরুতে তিনি সংস্কৃত পণ্ডিতদের চিন্তা-ভাবনাকে আশ্রয় করে প্রবন্ধের সূচনা করেছেন। তেলে বিশেষ গুণ যে স্নেহ তা প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি বক্তব্যে নিয়ে এসেছেন। যেমন- “সংস্কৃত কবিদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ। বাস্তবিকও স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমার স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়ে থাকি।” প্রাবন্ধিক তৈলের যে শক্তি তা তিনি বিভিন্ন ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সেই পর্যবেক্ষণজাত অভিজ্ঞতাকে এখানে তুলে এনেছেন। প্রাবন্ধিক দেখেছেন তৈলের সর্বশক্তিমত্তার প্রকাশ। যেখানে সবকিছু ব্যর্থ- সেখানে তৈল কীভাবে কাজ করে সফল হয়। প্রাবন্ধিকের ভাষায় : “বাস্তবিক তৈল সর্বশক্তিমান যাহা বলের অসাধ্য, যাহ৷ বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে।” হপ্রসাদ শাস্ত্রী তৈলের মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগের বশবর্তী হলেও কখনো বাস্তব থেকে সরে যাননি। তিনি তাই তৈলের আরো গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন : “তৈলের মহিমা অপরূপ। তৈল নহিলে জগতের কোন কার্য সিদ্ধ হয় না। তৈল নহিলে কল চলে না, প্রদীপ জ্বলে না, ব্যঞ্জন সুস্বাদু হয় না, চেহারা খোলে না, হাজার গুণ থাকুক তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না, তৈল থাকিলে তাহার কিছুরই অভাব থাকে না।”ম তবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর শুধু তৈলের ব্যবহার সম্পর্কে বলেই শেষ করেননি। তৈল কখন কীভাবে, কাকে মারতে হয় এবং তার গুণাগুণ কীভাবে প্রকাশ পায় সে সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন।চ “তৈল দিবার প্রবৃত্তি স্বাভাবিক। এ প্রবৃত্তি সকলেরই আছে এবং সুবিধামত আপন গৃহে ও আপন দলে সকলেই ইহা প্রয়োগ করিয়া থাকে। কৌশল করিয়া এক বিন্দু দিলে যত কাজ হয়, বিনা কৌশলে ক কলস ঢালিলেও তত হয় না।” বিদ্যা-বুদ্ধি-সম্পত্তিকে তৈল কীভাবে আরো মূল্যবান করে তোলে তা প্রাবন্ধিক আমাদের সামনে তার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেছেন- যা তৈলের গুণাগুণই প্রকাশ পায়। যেমন-
“যাহার বিদ্যা আছে, তাহার তৈল আমার তৈল হইতে মূল্যবান। বিদ্যার উপর যাহার বুদ্ধি আছে, তাহার আরো মূল্যবান তাহার উপর যদি ধন থাকে, তবে তাহার প্রতি বিন্দুর মূল্য লক্ষ টাকা। কিন্তু তৈল না থাকিলে তাহার বুদ্ধি থাকুক, হাজার বিদ্যা থাকুক, হাজার ধন থাকুক, কেহই টের পায় না।”
তৈলকে আমরা যে কতভাবে, কতকাজে ব্যবহার করি তা প্রাবন্ধিকের সরস ব্যঙ্গের মাধ্যমে চিত্রিত। হয়তো বাহ্য দৃষ্টিতে তা আমাদের সামনে ধরা পড়ে না। কিন্তু বাস্তবিক লেখকের যুক্তিগুলোকে আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। যেমন- “তৈলের যে মূর্তিতে আমরা গুরুজনকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম ভক্তি; যাহাতে গৃহিণীকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম প্রণয়; যাহাতে প্রতিবেশীকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম মৈত্রী; যাহা দ্বারা সমস্ত জগৎকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম শিষ্টাচার ও সৌজন্য, ফিলিনথপি’।” এভাবেই প্রাবন্ধিক তাঁর তৈল’ প্রবন্ধটিকে এগিয়ে নিয়েছেন এবং প্রবন্ধেরপরিণতিতে তাঁর স্বাভাবিক যুক্তিপূর্ণ বাক্য, সরসম কৌতুকরস সৃষ্টির প্রবণতা এবং সর্বোপরি মানব প্রকৃতি এবং সমাজের সারসত্য আবিষ্কার করেছেন তৈলের গুণাগুণ বিচারে। যেমন- “শেষে মনে রাখা উচিত, এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে।” সুতরাং আলোচনার এ পর্যায়ে আমরা বলতে পারি যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ প্রবন্ধের বিষয় হিসেবে তৈলের বিভিন্ন ব্যবহার, গুণাগুণ এ প্রবন্ধে স্থান পেয়েছে। তাই প্রবন্ধটির নামকরণ তৈল’ রাখা শিল্পসার্থকতার ছোঁয়াই বহন করে।