স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে? আলোচনা কর।
অথবা, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কতটুকু পরিলক্ষিত হয়েছে? ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে? বিবরণ দাও ।
উত্তর৷ ভূমিকা : শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নব্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নানা ধরনের জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়। দীর্ঘকালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন, এ বিষয়টির অনুভূতি বাঙালির শানিত ধারায় মিশে গিয়েছিল। নতুন রাষ্ট্রের সরকার, সংবিধান, বিধিমালা সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিষ্ঠা করার একটা প্রবল প্রচেষ্টা আর উন্মাদনা শুরু হয়েছিল। বাঙালির ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাঙালির ইতিহাস অর্থহীন। যুদ্ধোত্তরকালীন প্রাথমিক এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের পরবর্তী, রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ পর্যালোচনা : ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রভাব যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতটুকু ছিল তা নিচে বিভিন্ন ধাপে আলোচনা করা হয়েছে :
১. রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি ও ‘৫২ এর চেতনা : বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রণয়নের জন্য যে মৌলিক বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করা হবে, সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ চারটি মূলনীতির সবগুলোই স্বাধীনতা যুদ্ধের ভাবধারা থেকে গৃহীত। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ফলে ১৯৫২ সালের ভাষা
আন্দোলন এবং পরবর্তীতে এ আন্দোলনই রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনের সূচনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংবিধান রচনার প্রধান নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
২. ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র : ভারত ও রাশিয়ার সক্রিয় সমর্থন, সাহায্য সহযোগিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে বিধায় রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাশিয়ার সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করা হয়। ধর্মের নামে হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদেও বাঙালিরা মরণপণ লড়াই করে যুদ্ধ করেছে। বিজয় অর্জনের পরবর্তী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়
মুক্তিযুদ্ধকালীন এ ধর্মনিরপেক্ষতায় অনুভূতি নেতৃবৃন্দের মনে প্রভাব বিস্তার করবে- এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার । ৩. প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় ব্যবস্থা : নব্য রাষ্ট্রের সরকারের ধরন কিরূপ হবে, সে ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধকালীন মনোভাবের প্রতিফলন রয়েছে। ছয়দফার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ এখানে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের জন্য সংবিধানে বিধিমালা প্রবর্তন করে এবং সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এক দলীয় শাসন এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থা কার্যকর ছিল !
৪. মুক্তিযোদ্ধা নামে একাধিপত্য রাজনীতির ভিন্ন গতিপথ : স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এখানে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরূপ অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে। প্রবল সংকট সৃষ্টি করে। এসব মুক্তিযোদ্ধার প্রভাব প্রতিপত্তিতে পরবর্তী রাজনীতির গতিপথ ভিন্ন পথে প্রবাহিত হতে থাকে যা আদৌ সুস্থ রাজনীতির পরিচায়ক নয়।
৬. রাজনৈতিক উন্নয়নের ধারা : পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতাবাদের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন অতিবাহিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতনের পর স্বাধীন আবাস ভূমি অর্জনের পরও ঔপনিবেশিক
আমলের অভ্যাস ও মানসিকতা ত্যাগ করাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর তার যথাযোগ্য মর্যাদা ও স্বাধীনতা সুসংহত ও রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করাও সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। তথাপি প্রাথমিক দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি তার আপন গতিতে এগিয়ে চলতে সক্ষম হয়।
মূল্যায়ন ও মন্তব্য : রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টি। বিশ্ব ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিপ্লব যেমন- সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর রাষ্ট্রেও নব্য সমাজ অনেক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। এ বিশৃঙ্খলা পরিদৃষ্ট হয়েছে নেতৃবৃন্দের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সংঘাতের মাঝে, দেখা গেছে পরবর্তী রাজনীতির গতিধারা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভারসাম্যহীনতার মাঝে। নিকট অতীতের যে কোন ঘটনাই পরবর্তী
কোন বিষয়ে গভীর প্রভাব বিস্তার করবে এটা রাষ্ট্রব্যবস্থার ইতিহাসে অতি সাধারণ এবং স্বাভাবিক ঘটনা। অতএব, মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই সংশ্লিষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় তা গভীর প্রভাব বিস্তার করবে, এটা সর্বজনবিদিত। স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বলতে, প্রতিনিধিত্বশীল সংসদীয় ধারায় গণতন্ত্র প্রবর্তন,
সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র সাংবিধানিকভাবে মৌলিক অধিকার, সাম্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়গুলো এসেছে। কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে আবার বাধারও সৃষ্টি হয়েছে যেমন- আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি, মুক্তিযোদ্ধা নামে তরুণ যুবকদের বাড়াবাড়ি ও জোর জবরদস্তি, ইত্যাদি। তাছাড়া স্বাধীনতার কিছুকাল পরেই একদলীয় ‘বাকশাল’ ব্যবস্থার প্রবর্তন ইত্যাদিও স্বাধীনোত্তর কালে রাজনৈতিক গতিধারাকে ব্যাহত করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত অলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ‘আংশিক’ প্রতিফলিত হয়েছে। সাংবিধানিক ও রাজনৈতিকভাবে আর মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক। ও রাজনৈতিক উভয়ভাবেই।