অথবা, ব্রিটিশ সরকার বাংলার স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন?
অথবা, বাংলায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকল্পে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগসমূহ উল্লেখ কর।
অথবা, ব্রিটিশ সরকারের বাংলায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ সম্পর্কে বর্ণনা দাও।
অথবা,বাংলায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে ব্রিটিশ সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে যা জান লিখ।
ভূমিকা : ব্রিটিশপূর্ব বাংলায় স্বশাসিত স্থানীয় শাসন থাকলেও ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার সাথে সাথে তা পরিবর্তন হতে থাকে, ঔপনিবেশিক শাসন স্থায়ী করার জন্য তারা প্রথমেই ঐতিহ্যগত স্বায়ত্তশাসিত গ্রাম সরকারের ওপর আঘাত হানে।
বাংলায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকল্পে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগসমূহ: ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল হতেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গোড়াপত্তন ঘটে এ উপমহাদেশে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের পর পরই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং ১৮৫৮ সাল থেকে ইংরেজরা ভারতবর্ষ শাসনের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ করে। সিপাহি বিপ্লবের পর ইংরেজ সরকার অনুভব করেন এদেশ শাসন করতে হলে শুধু শোষণ নয় স্থানীয় এলাকার উন্নতি সাধনের নীতি গ্রহণ করতে হবে। ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় উদ্দেশ্যে কতকগুলো আইন পাস করেন, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য আইনগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. চৌকিদারি পঞ্চায়েত আইন ১৮৭০ : এই আইনই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ইতিহাসে প্রথম পদক্ষেপ। এই আইনের মাধ্যমে পল্লি অঞ্চলে একস্তর বিশিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েত নামে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়েছিল। এ আইনের বলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যে কোন ৫ জন গ্রামবাসীর সমন্বয়ে একটি চৌকিদারি পঞ্চায়েত গঠন করতেন। তবে এ পঞ্চায়েতের সদস্য সংখ্যা কমপক্ষে ৩ জন এবং বেশিরপক্ষে ৭ জন হতে পারত। তাদের প্রধান কাজ ছিল চৌকিদারি কর আদায় করা এবং চৌকিদারের সাহায্য নিয়ে গ্রামের শান্তিশৃঙ্খলা দেখাশুনা করা।
২. লর্ড রিপনের প্রস্তাব ১৮৮২ : লর্ড রিপনই সর্বপ্রথম এদেশে প্রকৃতিগতভাবে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনসাধারণকে অধিকতর রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান। ১৮৮২ সালের ১৮ মে লর্ড রিপন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের উপর প্রস্তাবনা ঘোষণা করেন।
৩. বঙ্গীয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন, ১৮৮৫ : এই আইনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের তিনটি স্তর করা হয়। যেমন— ১. ইউনিয়ন কমিটি ২. লোকাল বোর্ড ও ৩. জেলা বোর্ড। এই ব্যবস্থায় স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণের পথ সুগম হয়।
৪. বঙ্গীয় গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন আইন, ১৯১৯ : এই আইনের মাধ্যমে পূর্বেই তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় শাসনব্যবস্থাকে দুই স্তর বিশিষ্ট শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় এবং নির্বাচন রীতি প্রবর্তন করা হয়। প্রত্যেকটি জেলার জন্য জেলা বোর্ড শহরাঞ্চলের জন্য মিউনিসিপ্যালিটি ও গ্রামাঞ্চলের জন্য ৯ সদস্যের ইউনিয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কর আদায় করা ও চৌকিদারের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা ছিল বাধ্যতামূলক কাজ।
৫. ভারত শাসন আইন ও স্বায়ত্তশাসন, ১৯৩৫ : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়। এই আইন অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা মোট সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশে পরিণত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি করে। এ সময় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ দুটি ধারায় বিকাশ লাভ করে। শহরের পৌর এলাকার নানাবিধ সমস্যাদি সমাধানের জন্য মিউনিসিপ্যালিটি, কর্পোরেশন এবং বিভিন্ন ধরনের বোর্ড গঠন করা হয়। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় ইউনিয়ন বোর্ড, লোকাল বোর্ড ও জেলা বোর্ড।