অথবা, স্থানীয় সরকার কী? স্থানীয় সরকার কোন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা আলোচনা কর।
অথবা, স্থানীয় সরকার কাকে বলে? স্থানীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা কর।
অথবা, স্থানীয় সরকারের সংজ্ঞা দাও। স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, স্থানীয় শাসন কাকে বলে? স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় শাসনের ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, স্থানীয় সরকার বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব বর্ণনা কর।
ভূমিকা : রাষ্ট্রের মাঠ পর্যায়ের এলাকাভিত্তিক সরকারি কর্মকর্তাদের শাসনকে স্থানীয় শাসন বলা হয়। স্থানীয় শাসন বলতে স্থানীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের শাসন বুঝায় ।
স্থানীয় সরকার/শাসনের সংজ্ঞা (Definition of local government) : রাষ্ট্রের মাঠ পর্যায়ের এলাকাভিত্তিক সরকারি কর্মকর্তাদের শাসনকে স্থানীয় সরকার বলা হয়। এলাকাভিত্তিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় সরকার বা স্থানীয় শাসন বলে পরিচিত।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : সামাজিক বিজ্ঞান কোষের ব্যাখ্যা অনুযায়ী স্থানীয় সরকার বা স্থানীয় শাসনের অর্থ হলো, “এটি একটি জনসংগঠন যা কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের কোন একটি ক্ষুদ্র এলাকার সীমিত পরিমাণে দায়িত্ব পালন করে।” Encyclopaedia of Britannica অনুযায়ী, “স্থানীয় সরকার একটি নির্দিষ্ট, অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অঞ্চলের শাসন সংস্থাকে বুঝায়। কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনগণের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি ও তাদের বিভিন্ন সেবা প্রদানের জন্যই স্থানীয় সরকারের সৃষ্টি।” G.D.H.Cole এর মতে, “স্থানীয় সরকারসমূহ মূলত সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত এবং সরকার কর্তৃক অর্পিত কিছু দায়িত্ব পালন করে।” কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে এককভাবে দেশের যাবতীয় কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না, তাই সরকারের কার্যাবলি সুষ্ঠু ও যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য দেশের সমগ্র ভূ-ভাগকে বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক ভাগ করা হয়, এতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের ভারও কমানো সম্ভব। এসব এলাকাভিত্তিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই স্থানীয় সরকার নামে পরিচিত। বস্তুতপক্ষে স্থানীয় সরকার বিকেন্দ্রীকরণমূলক স্থানীয় প্রশাসন। বাংলাদেশে বর্তমানে বিভাগ, জেলা, উপজেলা স্থানীয় সরকারের উদাহরণ।
স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব : স্থানীয় সরকার বা স্থানীয় শাসন কেন্দ্রীয় সরকারেরই বিকেন্দ্রীকরণমূলক স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো :
১. স্থানীয় সমস্যা সমাধান : স্থানীয় শাসন স্থানীয় সমস্যা সমাধানের জন্য খুবই উপযোগী। কেন্দ্র হতে সমস্যার প্রকৃতি ও গভীরতা উপলব্ধি করতে করতে যে কোন সমস্যা জটিল রূপ ও আকার ধারণ করতে পারে। দ্রুত উপলব্ধি ও ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণপূর্বক স্থানীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে স্থানীয় শাসনের জুড়ি নেই। বিশেষ করে যে কোন ধারনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে কেন্দ্রের ভার লাঘব হয় এবং কেন্দ্রীয় শাসন চাপমুক্ত থেকে দায়িত্ব পালনের সুবিধা পায়।
২. স্থানীয় উন্নয়ন ও চাহিদা পূরণ : স্থানীয় উন্নয়ন ও জনগণের চাহিদা সম্বন্ধে স্থানীয় শাসন যতটা সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে, কেন্দ্রের পক্ষে ততটা ধারণা লাভ করা সম্ভব হয় না। কেন্দ্র হতে স্থানীয় পর্যায়ে তথা তৃণমূল অংশগুলো দূরে অবস্থিত হওয়ার কেন্দ্রীয় শাসনের সুবিধা দ্রুত পৌঁছতে পারে না। ফলে গণ অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। তাই স্থানীয় শাসকগণ স্থানীয় পর্যায়ের চাহিদা অনুযায়ী অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়। স্থানীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে স্থানীয় শাসন খুবই উপযোগী।
৩. স্থানীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় নির্দেশ বাস্তবায়ন : স্থানীয় শাসনব্যবস্থা ও কাঠামো দ্বারা কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্দেশনা দ্রুত স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য অবহিত করানো যায়। ফলে বিভাগ, জেলা, উপজেলার মাধ্যমে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়। তাছাড়া সরকার যখন দেশব্যাপী কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে চায় তখন তৃণমূল পর্যায় হতে নানা ধরনের তথ্যের প্রয়োজন হয়। স্থানীয় সরকার তার জনবল ও কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত
প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সরবরাহ করতে পারে।
৪. উন্নয়নকামী উদ্যোক্তা সৃষ্টি : সরকারি নীতিমালার অংশ হিসেবে শিল্প, শিক্ষা, কৃষি ও সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য স্থানীয় শাসন স্থানীয় উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় শাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা নিয়ে শিল্প উদ্যোগ, শিক্ষা সংক্রান্ত উন্নয়ন কার্যক্রম, কৃষিক্ষেত্রে সেচ, সার, বীজ ও ভর্তুর্কি সরবরাহ এবং সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। স্থানীয় শাসন সরকারের এজেন্ট হিসেবে দ্রুত ও সহজেই এসব কাজ করতে পারে বিধায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
৫. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনকে সহায়তা প্রদান : স্থানীয় শাসন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনকে সহযোগিতা, পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে জনগণের অংশগ্রহণকে অর্থবহ করে তোলেন। স্থানীয় নেতৃত্ব সৃষ্টিতে স্থানীয় শাসন নিবিড় ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন স্তরে নেতা ও নেত্রীদের বিভিন্ন প্রকল্পের দায়িত্ব তাদেরকে দক্ষ ও যোগ্য করে তোলে।
৬. দুর্যোগ মোকাবিলা : বাংলাদেশকে প্রায়শই সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়। স্থানীয় শাসনের মাধ্যমে সরকার দ্রুত দুর্যোগ মোকাবিলায় ত্বরিত ভূমিকা পালন করে।
৭. পুনর্বাসন কার্য বাস্তবায়ন : দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে দুর্যোগ কবলিত এলাকার মানুষকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, স্থানীয় শাসন তৃণমূল পর্যায়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, উন্নয়ন, উৎপাদন ও নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবি জানতে পারেন এবং সে লক্ষ্যে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেন।