উত্তর : ভূমিকা : সুলতানি আমলে মুসলিম শাসকগণ ইসলামের গৌরবকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে রাজ্যজয় করেছেন। তারা অনেক
জায়গায় মসজিদ, মাদ্রাসা, দুর্গ, দরগা, অট্টালিকা প্রভৃতি নির্মাণ করেন। তাদের শাসনকালকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। এসব
কাজকে শাসকেরা পুণ্যের কাজ মনে করতেন। এই পুণ্যের কাজ বা আত্মরক্ষার্থে যে কাজ তারা করে গেছেন সে কাজ আজ আমাদের
কাছে তাদের গৌরব বা কীর্তি, এসকল কীর্তিমূলক নির্মাণ কাজ বিশ্লেষণ করলে মুসলিম শাসন সম্পর্কে জানতে পারি যে ঐ সময়ে স্থাপত্য কীর্তি ছিল অত্যন্ত রুচিপূর্ণ ও জাঁকজমকপূর্ণ।
সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য : সুলতানি শাসনামলে বাংলায় স্থাপত্য কীর্তি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ
১. বড় সোনা মসজিদ : আসাম বিজয়ের পর ঘটনাটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য হোসেন শাহ বড় সোনা মসজিদটি নির্মাণ কাজ শুরু করে এবং এর কাজ শেষ করেন ১৫২২ বা
১৫২৭ সালে নুসরত শাহ। সোনালি রঙের গিলটি করা কারুকার্যের জন্য এর নামকরণ হয় ‘সোনা মসজিদ’। ১২টি দুয়ার আছে বলে একে ‘বার দুয়ারি’ মসজিদও বলা হয় ।
২. ছোট সোনা মসজিদ : ছোট আকারে নির্মিত ছোট সোনা মসজিদটি গৌড়ের দক্ষিণে ফিরুজাবাদ গ্রামে অবস্থিত। এর নির্মাতা হোসেন শাহের আমলের জনৈক ওয়ালি মুহাম্মদ। সোনালি রং এর গিলটির জন্য এর নাম সম্ভবত ‘ছোট সোনা মসজিদ’ মসজিদের পাশেই তার কবর রয়েছে। কারুকার্য ও
স্থাপত্য কলার উৎকর্ষতার জন্য এ মসজিদটি উল্লেখযোগ্য ।
৩. আদিনা মসজিদ : বিখ্যাত আদিনা মসজিদ ১৩৬৯ সালে সুলতান সিকান্দার শাহ পাণ্ডুয়া থেকে ১ মাইল উত্তরে নির্মাণ করেন। এটিই বাংলার বড় মসজিদ ছিল, যার দৈর্ঘ্য ৫৭৭ ফুট ও প্রস্থ ২৮০ ফুট।
৪. ষাট গম্বুজ মসজিদ : পঞ্চাশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এ মসজিদটি নির্মিত হয়। খান জাহান আলীর সমাধির তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে ষাট গম্বুজ মসজিদটি অবস্থিত। এটা বাংলার অন্যতম বৃহৎ মসজিদ। অপূর্ব গঠন শৈলীর জন্য বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ বঙ্গে মুসলিম শাসনামলের
গৌরব বৃদ্ধি করেছে।
৫. কদম রসুল মসজিদ : এমসজিদটি ১৫৩১ সালে নসরত শাহ নির্মাণ করেন। গৌড়ে অবস্থিত এ মসজিদটি মহা-বীর পদচিহ্নের
প্রতি সম্মান প্রদর্শনের স্বরূপ নির্মিত হয়। এর এক প্রকোষ্ঠে কালে কারুকার্য খচিত মর্মর বেদীর উপরিভাগে হযরত মুহাম্মদ (স.) এর
পদচিহ্ন সংবলিত এক খণ্ড প্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে।
৬. ফিরুজ মিনার : অনেকের ধারণা যে, ফিরুজ মিনারটি পাঁচতলায় বিভক্ত যার উচ্চতা ৮৪ ফুট। সুলতানি আমলের স্থাপত্য শিল্পের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উৎকৃষ্ট নিদর্শন হচ্ছে গৌড়ের ফিরুজ মিনার।
৭. একলাখী মসজিদ : জালাল উদ্দিনের শাসনামলের (১৪১৮-১৪৩২ সাল) উল্লেখযোগ্য কীর্তি একলাখী মসজিদ । তখনকার সময়ে এক লাখ টাকা ব্যয়ে এ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল বলে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘একলাখী মসজিদ’ বিরাট আয়তনের এ মসজিদে ১টি কবর ছিল। বলা হয় যে, রাজা গণেশের একলাখী বেদীর উপাসনার জন্য নির্মিত মন্দিরটি তার
পুত্র জালালউদ্দিন একলাখী মসজিদরূপে রুপান্তরিত করেন। এ স্থাপত্যকলায় হিন্দু স্থাপত্যরীতির প্রতিফলন লক্ষ করা যায় ।
৮. বাবা আদমের মসজিদ : ঢাকা জেলার রামপালে ১৪৮৩ সালে মালিক কাফুর ফতেহ শাহ এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। এটা
হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশের উপর নির্মিত, এ মসজিদের শিল্পকলা মাহমুদ শাহের গৌড়ের মসজিদের সাথে মিল রেখে করা হয়।
৯. লোটন মসজিদ : সুলতান ইউসুফ শাহের প্রিয়পাত্রী ও অনুগৃহিতা জৈনকা ‘লোটন বিবি’ (ধর্মান্তারিত) ১৪৭৫ সালে এটি
নির্মাণ করেন। এটি গৌড়ের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত।
১০. খান জাহান আলীর সমাধি : খুলনা জেলার বাগেরহাটে তার সমাধি নির্মিত আছে। সমাধিটির স্থাপত্যকলায় দিল্লির তুঘলক আমলের শিল্পকলার প্রভাব দেখা যায়। বলা হয় তিনি সুলতান নাসিরউদ্দিন ইলিয়াস শাহের সমসাময়িক ছি
লেন।
১১. দাখিল দরওয়াজ : গৌড়ের দাখিল দরওয়াজ আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সমাধি তোরণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দাখিল দরওয়াজ ৬০ ফুট উচু ও ৭৩ ফুট প্রশস্ত। কারুকার্য
শোভিত সম্মুখভাগের মধ্যস্থলে ৩৪ ফুট উঁচু খিলানযুক্ত বিশালতোরণ রয়েছে। এটি ইস্টক নির্মিত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সুলতানি আমলে বাংলায় স্থাপত্য শিল্পের যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধিত হয়। সুলতানদের পাশাপাশি ব্যক্তিক উদ্যোগে স্থাপত্য শিল্পের
বিকাশ ঘটে। গৌড় ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে যেসব মসজিদ ও সমাধি রয়েছে তা সে যুগের উৎকৃষ্ট স্থাপত্য শিল্পের পরিচায়ক। সুলতানেরা যে স্থাপত্য নিদর্শন রেখে গেছেন তা আজো বাংলার আবহমান বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত। বাংলার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সূচনা করেছে এমন স্থাপত্য নিদর্শন যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট দীপ্ত পদচারণা করবে।