উত্তর : ভূমিকা : ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয় ও মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় এদেশে প্রায়
দুইশত বছরের স্বাধীন সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে । স্বাধীন সুলতানদের শাসনামলে বাংলায় স্থাপত্য শিল্পের অভূতপূর্ব বিকাশ
ঘটেছিল। সুলতানদের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপত্য শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছিল। স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসে বাংলা এক উচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছিল এই সুলতান আমলেই। সুলতানি স্থাপত্য ছিল মুসলিম স্থাপত্যরীতি ও কৌশল এবং স্থানীয় স্থাপত্য রীতি ও কৌশলের সমন্বয় ও সংমিশ্রণ ফলশ্রুতি। এসময় বাংলার স্থাপত্য মূলত-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারার উত্তর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। তাই বাংলার স্থাপত্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল ।
→ সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ : সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য শিল্পের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. মিনার : মিনার সুলতানি আমলের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। মসজিদ, মাজার, দুর্গ, ও তোরণ দ্বারা মিনার তৈরি হতো। যেমন- গৌড়ের ফিরুজ মিনার, ‘দাখিলি দরওয়াজা’, লালবাগের
কেল্লা, ষাটগম্বুজ মসজিদ প্রভৃতি।
২. খিলান : খিলান সুলতানি আমলের নির্ভরযোগ্য নির্মাণ কৌশল। লম্বালম্বিভাবে অসংখ্য ইস্টক বা প্রস্তরখণ্ড পরপর
এমনভাবে স্থাপন করা হয় যে, প্রত্যেকটি ইট বা ইস্টক সামান্য বাড়তে থাকে এবং বক্রাকার খিলান সৃষ্টি হয়। যেমন- গৌড়ের বড় সোনার মসজিদ। এ মসজিদে ১১টি খিলান আছে ।
৩. গম্বুজ : গম্বুজ সুলতানি স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মসজিদ সমাধি সৌধ, অট্টালিকা প্রভৃতিতে গম্বুজ ব্যবহার করা হতো। তবে মসজিদেই বেশি গম্বুজ এর ব্যবহার দেখা যায়। যেমন— ষাট গম্বুজ মসজিদ, আদিনা মসজিদ, বড় সোনা মসজিদ, সাত গম্বুজ মসজিদ, লালবাগ মসজিদ, গৌড়ের তাঁতি পাড়া মসজিদ, দারাস বাড়ি মসজিদ ও খান জাহান আলীর সমাধি।
৪. ইস্টক : ইস্টক রীতি বা ইটের বহুল ব্যবহার ছিল এ সময়ে। বাংলার পাথরের দুষ্প্রাপ্যতায় ইটের এমন ব্যবহার হতো, এ স্থাপত্য সুলতানি আমলকে বৈশিষ্ট্য ঐতিহ্য দান করেছে।
মসজিদ, সমাধি, দুর্গ, মিনার প্রভৃতিতে এ পদ্ধতি ব্যবহার হত। যেমন- ষাট গম্বুজ মসজিদ, লালবাগ কেল্লা প্রভৃতি।
৫. চালা : চালারীতি সুলতানি আমলের নির্মাণ কৌশলের অন্যতম একটি পদ্ধতি। গ্রামাঞ্চলে বক্র আকারে ছাদবিশিষ্ট দোচালা ও চৌচালা রীতিতে বাঁশ দিয়ে আবাস নির্মাণ করা হতো। ১৪৫৯ সালে নির্মিত ষাটগম্বুজ মসজিদটি চৌচালা রীতির পরিচয় বহন করে। এছাড়া আরও কতিপয় বৈশিষ্ট্য আছে। যথা-
→ বেদীর উপর আর্চ থাকত ।
→ দালানগুলোতে টেরাকাটা সাজসজ্জা দেখা যায়। টেরাকাটা কারুকার্যের সমাবেশে দেয়ালগুলো নানা বর্ণে চিত্রিত ও রঞ্জিত ছিল।
→ উজ্জ্বল ও রঙিন চকচকে টালির ব্যবহার ছিল।
→ লতাপাতা, Chain and bell প্রভৃতি স্থানীয় নকশা ছিল ।
→ কোনো প্রাণী বা জীবের মূর্তি ব্যবহার করেননি। কারণ ইসলামে এটি নিষেধ করা হয়েছে।
→ অষ্টভুজ বিশিষ্ট Comer tower ও চক্রাকৃতি প্রাচীরের ব্যবহার ।
→ পাথরের উপর সাজসজ্জা। গেটের তোরণে, খামের স্তম্ভে পাথরের ব্যবহার ছিল। তবে পারদের ব্যবহার কম ছিল।
উপসংহার: পরিশেষে একথা বলা যায় যে, সুলতানি আমলে বাংলায় স্থাপত্যের বিকাশ ছিল বাংলার মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা মুসলিম ঐতিহ্য, দেশীয় ঐতিহ্যের সমন্বয় এবং
সংমিশ্রণের ফলশ্রুতি। সুলতানি আমলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা বিভিন্ন মসজিদ, মাজার, সৌধ, কেল্লা বা দুর্গ ও মিনার
প্রভৃতিতে বাংলার স্থানীয় ও মুসলিম ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে সুলতানি আমলের স্থাপত্যসমূহ অপূর্ব নিদর্শন বহন
করে চলেছে। এর ফলে বাংলার গৌরব বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।