উত্তর : ভূমিকা : সুলতানি আমলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল। প্রাচীন বাংলার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি সুলতানি
আমলেও প্রচলিত ছিল। কৃষির কারণেই এ যুগের গ্রামীণ অর্থনীতি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে স্বভাবতই এ যুগের রাজস্বব্যবস্থা ছিল সুষ্ঠু ও প্রজা কল্যাণকর সুলতানি আমলে বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থার প্রধান উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব । ভূমি থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়েই সুলতানদের দরবার পরিচালিত হতো।
→ সুলতানি আমলে বাংলার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা : নিম্নে সুলতানি আমলে বাংলার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. ভূমি রাজস্ব বিভাগ : সুলতানি আমলে বাংলার রাজস্ব আদায়ের জন্য ভূমি রাজস্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। কারণ রাজস্বের উৎসগুলোর মাঝে সবচেয়ে অগ্রাধিকারভুক্ত বিভাগ হলো ভূমি রাজস্ব বিভাগ ।
২. শের-ই-গোমস্তা : সমসাসরিক কালের শিলালিপি থেকে জানা যায় যে সুলতানি আমলে শের-ই-গোমস্ত উপাধিধারী কর্মচারী
ভূমি রাজস্ব বিভাগের প্রধান ছিলেন। তার অধীনে গোমস্তারা, ভূমি রাজস্ব আদায়ের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। গোমস্তাগণ আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে জমিদারদের নিকট থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে রাজস্ব আদায় করতেন। ভূমি রাজস্ব আত্মসাতের অভিযোগে কঠোর শাস্তির বিধান ছিল।
৩. হিরণ্য ও গোবর্ধন : হোসেন শাহের শাসনামলে হিরণ্য ও গোবর্ধন নামক দু’জন ভূমি রাজস্ব কর্মচারীর নাম পাওয়া যায়।
বাংলা সাহিত্যে উল্লিখিত এই দু’জন হিন্দু অমাত্য সপ্তগ্রাম মুলুকের ভূমি রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন।
৪. অধিকারী : সুলতানি প্রশাসনে অধিকারী উপাধিধারী একজন কর্মচারী ছিলেন। তিনি রাজস্ব আদায় করতেন তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে অধিকারী শব্দটি দ্বারা অনুমান করা হয় তিনি রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন।
৫. রাজস্বের পরিমাণ : সুলতানি আমলে বাংলার ভূমি রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ এ বিষয়ে তথ্য সূত্রের অভাব রয়েছে। তবে চীনা বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সুলতানি আমলে বাংলার ভূমি রাজস্বের পরিমাণ ছিল উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশ। এই সময়ে দিল্লিতে আলাউদ্দিন খলজি দোয়াব
অঞ্চলে উৎপাদনের অর্ধেক অংশ ভূমি রাজস্ব হিসেবে নির্ধারণ করেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই সময়ে বাংলার রাজস্ব
এক-পঞ্চমাংশ নির্ধারিত ছিল বলে উল্লেখ করেছেন।
৬. রাজস্ব আদায়ের সময়সীমা : সুলতানি আমলে ভূমি রাজস্ব আদায়ের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। প্রতি বছরের ভূমি রাজস্ব ফসল তোলার নির্দিষ্ট সময়ে জমা জমা প্রদান না করতে পারলে শাস্তির বিধান ছিল।
৭. রাজস্ব আদায় : হিরণ্য গোবর্ধন ও অধিকারী পদবিধারী প্রতি বছর ২০ লক্ষ টাকা খাজনা সংগ্রহ করতেন এবং ৮ লক্ষ টাকা নিজেরা রেখে বারো লক্ষ টাকা সুলতানের কোষাগারে পাঠাতেন। মিনহাজ-ই-সিরাজ বলেন, আলী মর্দান খলজি সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজারা ভূমি রাজস্ব পাঠাতে শুরু করেন। যুগীস-উদ-দীন নদীয়া ও
মান্দারনের ভূমি রাজস্বের দ্বারা এবং রুকনুদিন কাইকাউস বঙ্গের ভূমি রাজস্বের দ্বারা মুদ্রা প্রচলন করেন। সুলতান ফিরোজশাহ তুঘলক বাংলা আক্রমণ করলে তিনি এক ঘোষণাপত্র মারফত জমিদারদের ভূমি রাজস্ব মওকুফ করার প্রতিশ্রুতি দেন।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে একথা বলা যায় যে, সুলতানি আমলে বাংলার ভূমি রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায়ের সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে মিহাজ-ই- সিরাজ ও বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি বিবরণী থেকে আংশিকভাবে ধারণা লাভ করা যায়। রায়তরা কি নগদ অর্থে নাকি উৎপাদিত ফসল দ্বারা ভূমি রাজস্ব আদায় করতেন তাও জানার কোনো উপায় নেই। তবে বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে, সুলতানি আমলে বাংলার ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা ছিল।