অথবা, সুফি শব্দের উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, সুফি শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে তোমার অভিমত দাও।
অথবা, সুফি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে কিভাবে?
উত্তর।৷ ভূমিকা : সুফিবাদ ইসলামি জীবনদর্শনের সর্বোচ্চ স্তরে বিকশিত ধ্যান অনুধ্যানমূলক মরমি চিন্তাধারা, ধ্যান অনুধ্যানমূলক সাধনার মাধ্যমে পরম, একক ও অদ্বিতীয় সর্বময় সত্তা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভই সুফিবাদের মর্মকথা। ইসলামের ইতিহাসে যেসব আধ্যাত্মিক সাধক মরমি অভিজ্ঞতা ইনটুইশন বা স্বভাব সাহায্যে আল্লাহর সঙ্গে একাত্মতা অর্জনে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তারা সুফি নামে পরিচিত। কিন্তু এ সুফি শব্দটির উৎপত্তি কোথা থেকে তা নিয়ে সুফি সাধক এবং ইসলামি চিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
সুফি শব্দের উৎপত্তি : ‘সুফি’ শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিকদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। ‘সুফি’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ পশমি পোশাক পরিধানকারী; অনেকে মনে করেন আরবি ‘সুফি’ অর্থাৎ ‘পশম’ শব্দ থেকেই সুফি শব্দের উদ্ভব হয়েছে। প্রাক ইসলামি যুগেও সুলভ পশমি পোশাককে সাদাসিধা অনাড়ম্বর আধ্যাত্মিক জীবনাচরণের সাথে যুক্ত করা হতো। স্বয়ং নবী করীম (স) বলেছেন, আল্লাহর সাথে কথা বলার সময় মূসা নবী পশমি পোশাক পরিহিত ছিলেন। এমনকি মহানবী নিজেও পশমি পোশাক পছন্দ করতেন এবং এও জানা যায় যে তিনি পশমি পোশাক পরিহিত অবস্থায়ই পরলোকগমন করেন। তাই দেখা যায় ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে যাঁরা পশমি কাপড় পরিধান করতেন, অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন তাঁরাই সুফি নামে পরিচিত। যদিও, একথা ঠিক যে, পশমি পোশাক পরা সুফিদের কোন একচেটিয়া অধিকার ছিল না কিংবা তা দিয়ে সুফিবাদের স্বরূপ ব্যাখ্যার প্রচেষ্টাও কোন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নয়। তথাপিও এ নামকরণের সময় পশমি পোশাকের সঙ্গে সুফি কথাটির উল্লিখিত ঐতিহাসিক যোগাযোগকে যে যথার্থই ব্যবহার করা হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই বলেই অনেক মনে করেন। কিন্তু এ মতের বিরোধিতারা মনে করেন ‘সুফ’ শব্দ থেকে সুফি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে এ মতবাদে সুফিদের অবয়ব ও পোশাকের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু সুফিবাদ
ইসলামের বাতেনি বা অভ্যন্তরীণ দিক। তাই শুধু বাহ্যিক দিকের নির্দেশক ‘সুফ’ বা ‘পশম’ শব্দ থেকে সুফি শব্দের উদ্ভব হয়েছে একথা বলা যায় না। অনেকের মতে, ‘আসহাবে সুফিফা’ বা ‘আহলুস সুফফা’ শব্দ থেকে ‘সুফি’ শব্দের উদ্ভব হয়েছে। মহানবীর জীবদ্দশায় তাঁর কতিপয় ঘনিষ্ঠ সাহাবা মসজিদ ই নববীতে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। এদের মধ্যে হযরত সালমান ফারসী (রা), হযরত আবু জর গিফারী (রা), হযরত আমর (রা), হযরত মায়াজ (রা) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদেরণেই বলা হতো আসহাবে সুফফা’ বা ‘আহলুস সুফফা’। এসব সাহাবা নিজেদের জীবন, ধন-মান, সংসার, স্ত্রী-পুত্র, পরিজন সবকিছু আল্লাহ ও রাসূলের নিমিত্ত উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁরা অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। দারিদ্র্যই ছিল তাঁদের জীবনের ভূষণ। এদের আচার আচরণ ক্রিয়াকলাপ ও অভ্যন্তরীণ গঠন ও সাধনা পদ্ধতির সাথে সুফি জীবনের সামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। তাছাড়া তাঁদের মধ্যে অনেকেই ‘পশম’ দ্বারা তৈরি পোশাক ও কম্বল ব্যবহার করতেন। তাই আসহাবে সুফফা’ শব্দ থেকে ‘সুফি’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। অন্য আরেকটি ভাষ অনুসারে ‘সাফ’ বা ‘সারি পংক্তি বা কাতার থেকেই ‘সুফি’ শব্দের উদ্ভব হয়েছে। তাঁদের যুক্তি হলো সুফিরা প্রথম কাতর মানুষ তাই তাঁদের এরূপ নামকরণ। আবার মোল্লা জামী (রা) ও তাঁর অনুসারীদের মতে, ‘সাফা’ বা পবিত্রতা শব্দ থেকে সুফি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। এ মতে, চারিত্রিক পবিত্রতা বা বিশুদ্ধি সুফি জীবনের এক অলঙ্ঘনীয় বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ পুত পবিত্র চরিত্রের অধিকারী বলে তাঁদের এরূপ নামকরণ। কিন্তু এ মত সুকি জীব
নের একটি বিশেষ দিক নির্দেশ করে মাত্র যা সামগ্রিক অর্থে সুফি শব্দের উৎপত্তি নির্দেশক নয়। আবার পশ্চাত্যের কতিপয় পণ্ডিত যেমন আর এ নিকলসন মনে করেন, গ্রিক শব্দ ‘সোফিস্ট’ থেকে সুফি শব্দের উদ্ভব হয়েছে। ‘সোফিস্ট শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’ আর সুফিরা বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ জ্ঞানের অধিকারী বিধায় ‘সোফিস্ট’ শব্দ থেকে
‘সুফি’ শব্দের উদ্ভব হয়েছে বলে তাঁরা যুক্তি দেন। কিন্তু এ মতকে কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কেননা, ইসলামের উপর গ্রিকবাদের তেমন কোন প্রভাব আছে এর কোন সমর্থিত তথ্য নেই।
উপসংহার : অতএব পরিশেষে বলা যায়, ‘সুফি’ শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা মতভেদ থাকলেও ‘আসহাবে ‘সুফফা’ শব্দ থেকে ‘সুফি’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলাই যুক্তিযুক্ত। কেননা, এর মধ্যে সুফি জীবনাদর্শের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিকেরই সমন্বয় লক্ষ করা যায়। আসহাবে সুফফারা অনাড়ম্বর পুত পবিত্র জীবন ধারণ করতেন আবার পশমি পোশাকও পরিধান করতেন। অতএব এ থেকেই সুফি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলাই শ্রেয়।