অথবা, সুফি যোগতত্ত্ব কী?
অথবা, সুফি যোগতত্ত্ব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সুফি যোগতত্ত্ব সম্পর্কে যা জান লেখ।
অথবা, সুফি যোগতত্ত্ব সংক্ষেপে লেখ।
উত্তর।। ভূমিকা : মানুষের মরমি প্রবণতা তথা পরমসত্তার সাথে একাত্মবোধের বাসনা স্বাভাবিক প্রবৃত্তিজাত। আধ্যাত্মিক বোধের এ তাগিদ থেকেই মানুষ জগৎসংসারের সবকিছু ত্যাগ করে একমাত্র পরমসত্তার দিদার লাভের পথে আত্মোৎসর্গ করতে মোটেও দ্বিধান্বিত হয় না। ইসলামি চিন্তার পরিসরে বিকশিত এ আধ্যাত্মিক বা মরমি দিকটিই তাসাউফ বা সুফিবাদ নামে পরিচিত। সুফি তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনায় যেসব তত্ত্ব বা তাত্ত্বিক পদ্ধতি অবলম্বনে অগ্রসর হন তন্মধ্যে যোগতত্ত্ব অন্যতম প্রধান।
সুফি যোগতত্ত্ব : যে কোন মরমি দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর সাধন পদ্ধতি। মরমি আদর্শের সাধক সাধনার মাধ্যমেই তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হবার পথে অগ্রসর হন। এ সাধন পদ্ধতি যতই কঠোর ও কঠিন হোক না কেন সাধক পথকে আঁকড়ে ধরেন তার সর্বস্ব দিয়ে। আধ্যাত্মিক পথের অনুসারী ধার্মিক কিংবা ধর্মবহির্ভূত যে কোন সাধককেই আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য সাধন পদ্ধতিকে অনুসরণ করতে। যোগতত্ত্ব বলতে মূলত আধ্যাত্মিক সাধকের এক ধরনের সাধন পদ্ধতিকেই বুঝায়। এ সাধন পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে দেহকেন্দ্রিক। অর্থাৎ মানব দেহই যোগ সাধনার কেন্দ্রবিন্দু।ভারতীয় উপমহাদেশের দর্শন অধ্যয়ন করলে দেখা যায় সুফিদের আগমনের পূর্বে এদেশে তথা প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ ও হিন্দু তান্ত্রিক সাধনা যোগ সাধনা ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে প্রাচীন ভারতের যোগাচার সম্প্রদায় দেহকেন্দ্রিক যোগ সাধনাকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন সর্বান্তকরণে। পরবর্তীতে এদেশে সুফিবাদের প্রচার ও প্রসার ঘটলে গ্রহণ বর্জনের যে পালা ঘটে তাতে সুফি সাধনার সাথে এদেশীয় সাধনার সংযোগ ঘটে। এর প্রেক্ষিতে উদ্ভব হয় নব্য সুফিদের। এ নব্য সুফিদের সাধন পদ্ধতিতে এদেশীয় সাধন পদ্ধতির প্রভাবে দেহ সাধনা আধ্যাত্মিক সাধনার অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়। আর বাংলার নব্য সুফিদের দেহকেন্দ্রিক এ সাধন পদ্ধতিই সুফি যোগ তত্ত্ব নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলার সুফি
সাহিত্যে এ যোগ চর্চা নির্ভর আধ্যাত্মিক সাধনার কথা আলোচিত হয়েছে সুস্পষ্টভাবে। বাংলার নব্য সুফিরা দেহের মধ্যেই প্রেমাস্পদ অর্থাৎ পরমসত্তার অনুসন্ধান করেন। সুফি পথ অতিক্রম এবং ঐশী জ্ঞান ও সাক্ষাৎ উপলব্ধির এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় জিকির। অবশ্য কুরআনের আয়াত আবৃত্তির মাধ্যমে। আল্লাহর জিকির ও এবাদত ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্রই অনুশীলন করেন এবং এদিক থেকে তা কেবল সুফিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তবে এই একই অনুশীলন সুফিদের মধ্যে পরিগ্রহ করে এক বিশেষ রূপ ও চরিত্র। তাঁরা যে পদ্ধতিতে জিকির অনুশীলনে ব্রতী হন তাই তাঁদের স্বাতন্ত্র্যকে তুলে ধরে। সুফিদের এ জিকির সাধনা মূলত দেহকে কেন্দ্র করেই ৭ম্পাদিত হয়। তাঁরা এ জিকির করেন কখনো দম বন্ধ করে। আবার কখনো দমের সঙ্গে। দেহের দশ লতিফা আব, আতস, খাক, বাত, নফছ, রুহ, কলব, ছির, খদি ও আখফা অর্থাৎ দেহের দশটি স্থানের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে জিকির করা হয়। আর এখানে সুফিবাদ দেহ বা যোগ সাধনার সাথে সম্পৃক্ততা লাভ করে। সুকিনের এ দেহ সাধনা একটি আধ্যাত্মিক সাধনা। এ সাধনার মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে পরমসত্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তবে বাংলার সুফিরা দেহের মাধ্যমে সাধনা করলেও আল্লাহ ও মানুষের প্রেম মিলনই তাঁদের সাধনার মূল কথা।
উপসংহার : অতএব বলা যায়, দেহকেন্দ্রিক বা যোগতাত্ত্বিক সুফি সাধন পদ্ধতি মূলত বাংলার নব্য সুফিদের একটি স্বকীয় সাধন পদ্ধতি। এদেশের সংস্কৃতিতে বিদ্যমান আধ্যাত্মিক সাধন পদ্ধতির সংমিশ্রণ থেকেই নব্য সুফিবাদ দেহ সাদার আত্মীকরণ করেছে।