অথবা, আত্মা সম্পর্কে সুফিবাদের ব্যাখ্যা তুলে ধর।
অথবা, সুফি আত্মাতত্ত্ব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, আত্মা সম্পর্কে সুফি দর্শনে কী বলা হয়েছে?
অথবা, সুফি দর্শনের আলোকে আত্মাতত্ত্ব আলোচনা কর।
অথবা, সুফি আত্মাতত্ত্ব কী?
উত্তর।৷ ভূমিকা : আল্লাহ ব্যতীত অপর সবকিছু থেকে আত্মা বা হৃদয়কে পবিত্র করে সব সময় আল্লাহর আরাধনায় নিমগ্ন হওয়ার নাম তাসাউফ বা সুফিবাদ আত্মাকে কালিমামুক্ত করে খোদার দর্শন ও চিরশান্তি লাভ সুফিবাদের মূল উদ্দেশ্য। তাই আত্মতত্ত্ব সুফিবাদ বা সুফি দর্শনে একটি গুর পূর্ণ তত্ত্ব হিসেবে খ্যাত।
আত্মতত্ত্ব : সাধারণভাবে আত্মা বলতে আমরা এমন একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্যকে বুঝি যা দেহকে ধারণ করে থাকে। কিন্তু কেউ কেউ আত্মাকে সতত পরিবর্তনশীল মানসিক প্রক্রিয়ার ধারা বলে ব্যাখ্যা করেন। আবার অনেকে বলেন আত্ম একটি অতীন্দ্রিয় ও সক্রিয় সত্তা, যার কাজ হচ্ছে বিভিন্ন সংবেদনের মধ্যে সংযোগ বা ঐক্য স্থাপন করা। কিন্তু সুফি দর্শনে আত্মার ধারণা ব্যাখ্যাত হয়েছে তাঁদের স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে। সুফি দর্শনের ব্যাখ্যায় আত্মার ধারণাটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিরোনামে আলোচিত হয়েছে। যেমন- আত্মাতত্ত্ব, আরোহণতত্ত্ব, মনতত্ত্ব, চন্দ্ৰ তত্ত্ব ইত্যাদি। সুফি দর্শন অনুসারে মানব দেহের চেতনা বা আত্মাই মন, সুফিরা মন বলতে পরিবর্তনশীল মানসিক ক্রিয়াকেই বুঝেন। অবশ্য পরবর্তীকালের তথা নব্য সুফিরা ‘আরোহা’ শিরোনামেই আত্মা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ‘আরোহা’ রুহ শব্দের বহুবচন। ‘ইসলাম ধর্মের সাধারণ বিশ্বাসীর মতো সুফিরাও মনে করেন মানুষের রুহ বা আত্মা পরমাত্মারই অংশ। কিন্তু এ রুহ বা আত্মার স্বরূপ কি? এ প্রশ্নের কোন সোজা উত্তর সুফিরা দেননি। এ প্রসঙ্গে সুফিদের মনোভাব ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মোঃ সোলায়মান আলী সরকার তাঁর ‘বাংলার সুফিবাদ : নব্য সুফিবাদ’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেন “কেহ যদি জিজ্ঞাসিল আরোহা কি এ বুলিতে না পারি তারে নিশানি নির্ণয়”। সুফিরা মনে করেন ‘রূহ’ ‘অমর’ অর্থাৎ হুকুম বা আদেশের অন্তর্ভুক্ত, ‘খালক’ অর্থাৎ সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত নয়। দেহ সৃষ্টির পর আত্মাকে দেহের ভিতর প্রবেশ করানো হয়েছে। আবার মৃত্যু বা দেহের ধ্বংসের পর আত্মা তার আপন উৎসে ফিরে যায়। তাই সুফি দর্শন অনুসারে আত্মা অসৃষ্ট অমর। বিভিন্ন সুফি বিভিন্নভাবে আত্মা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সুফিদের মধ্যে সেরা সুফি আল গাজ্জালীর মতে আত্মাকে কালিমামুক্ত করে খোদার দর্শন ও চিরশান্তি লাভ করা যায়। তাঁর মতে, সাধারণভাবে মানুষের দু’রকমের আত্মা আছে জীবাত্মা ও মানবাত্মা । মানবাত্মা আধ্যাত্মিক ও অতীন্দ্রিয় সত্তা, পরম সত্তার সাথে এ সত্তার মিল রয়েছে। আত্মার এ গুণাবলির মাধ্যমে মানুষকে পশু থেকে আলাদা করা যায়। এ আত্মাই হচ্ছে আসল মানুষ, সুফিরা মনে করেন আত্ম জ্ঞানই তত্ত্ব জ্ঞানের সোপান। আত্মতত্ত্ব যে জানে সেই পরম তত্ত্বের জ্ঞান লাভ করে। তাছাড়া প্রখ্যাত সুফি দার্শনিক মনসুর হাল্লাজ, বায়েজিদ বোস্তামি, রুমি প্রমুখ আত্মা ও পরমাত্মার স্বরূপ অভিন্ন বলে মনে করতেন। তবে তাঁরা আবার একই সঙ্গে সাবধান করে দেন যে, আত্মা ও পরমাত্মা সম্পূর্ণ অভিন্ন নয়। ‘যার আত্মা ও পরমাত্মা যে সম্পূর্ণরূপে অভিন্ন নয় তা প্রমাণ করতে সুফি দর্শনে জীবনের অস্তিত্বের চারটি স্তর বা আত্মার চার অবস্থার কথা বলা হয়। যথা : জড়ীয় আত্মা, উদ্ভিদ আত্মা, জীব বা পশু আত্মা এবং মানবাত্মা। প্রকৃত প্রস্তাবে এ চার স্তর একই আত্মার চার অবস্থা মাত্র। সুফিদের আত্মা সম্পর্কিত এই মতবাদের সাথে বৌদ্ধ নৈরাত্মবাদ, চার্বাক মতবাদ, আল ফরাবি, ইবনে সিনা প্রমুখ মুসলিম দার্শনিকের মতবাদের যথেষ্ট মিল রয়েছে।
উপসংহার : আলোচনার সমাপ্তিতে বলা যায়, পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম হবার সা
ধনাই একজন সুফির সারা জীবনের সাধনার মূল লক্ষ্য। আর এ সাধনায়ই তাঁর সমগ্র জীবনমান, দেহমন আত্মাকে নিবেদন করেন। কেননা, সুফি বিশ্বাস করে আত্ম তত্ত্ব যে জানে সেই পরম তত্ত্বের জ্ঞান লাভ করে।