সুফিবাদ কী? সুফিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, সুফিবাদ কী? সুফি অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সুফিবাদ কী? একজন সুফির আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য তোমার নিজের ভাষায় লেখ।
অথবা, সুফিবাদের সংজ্ঞা প্রদান পূর্বক এর বৈশিষ্ট্যসমূহ চিহ্নিত কর।
অথবা, সুফিবাদের সংজ্ঞা দাও। সুফিবাদের কী কী বৈশিষ্ট্য রয়েছে?
উত্তরা।৷ ভূমিকা :
সুফিবাদ হচ্ছে এক ধরনের মরমি ভাবধারা। এ ভাবধারা সমাজের প্রতিটি স্থানে কিছু সংখ্যক লোকের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এ ভাবধারা সেসব লোকের মধ্যে অনুসৃত হয়েছিল, যা ছিল আল্লাহর ক্রোধের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত এবং তারা আল্লাহর করুণা লাভের প্রত্যাশী। ইসলামের ইতিহাসে যারা অতিপ্রাকৃত উপায়ে আল্লাহর সাথে একাত্মতা অর্জনে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তারা সুফি নামে পরিচিত। সুফিবাদ তাত্ত্বিক দিকের চেয়ে ব্যবহারিক দিকের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়।
সুফিবাদ : সুফিবাদ এক প্রকার রহস্যময় আধ্যাত্মিক মতবাদ। সুফি ভাবধারার মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর গূঢ় অনুভূতির অন্বেষণ ও আত্মার পবিত্রতা বিধান। মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন সাধন। সুফি সাধকেরা অদ্ভরের গভীর অনুভূতির দ্বারা আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চান। তাদের মতে, ন্যায়-নীতি, ভয়-ভীতি অপেক্ষা আন্তরিক ভালোবাসার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। সুফিরা অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে পরমসত্তাকে উপলব্ধি করেন। সুফিদের মতে, কেবল স্বজ্ঞার মাধ্যমেই আল্লাহকে পাওয়া যেতে পারে। আল্লাহর ধ্যান ও আল্লাহর প্রেম সুফিবাদের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আবুল হুসাইন আল নূরির মতে, “যে মতবাদে ইন্দ্রিয়জ আত্মার সকল প্রবৃত্তিকে বিসর্জন দেয়ার কথা বলা হয়েছে তাই সুফিবাদ।”
জুনায়েদ বাগদাদি বলেন, “যে মতবাদে জীবন মৃত্যুসহ সকল বিষয় আল্লাহর উপর নির্ভরতার সাথে কথা বলা হয়েছে সে মতবাদই সুফিবাদ।”
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, সুফিবাদ এমন একটি মতবাদ যে মতবাদ ইসলামি শিক্ষার সে দিকটিই নির্দেশ করে, যেটিকে পারলৌকিক, বৈরাগ্যতা ও খোদাভক্তির প্রতি অধিক জোর দেয়া হয়েছে। সুতরাং সুফিবাদ হচ্ছে আল্লাহর প্রেমে নিমগ্ন থাকার দর্শন।
সুফিবাদের বৈশিষ্ট্য : সুফিবাদ ইসলামবাদের এক অতীন্দ্রিয় মরমী ভাবধারা। এ ভাবধারার মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর প্রেমের পরম উপলব্ধি। সুফি সাধকরা মনে করেন, পার্থিব সুখ-দুঃখ, অভাব-অতৃপ্তি ভুলে গিয়ে সর্বপ্রকার মায়া মমতার বন্ধনকে ছিন্ন করে অনন্ত অসীমের সঙ্গে মানবাত্মার মিলনের যে গোপন অভিসার তা হলো সুফি সাধনা। নিম্নে সুফিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. সুফি অভিজ্ঞতা সাক্ষাৎ বা পরোক্ষ নয় : সুফি অভিজ্ঞতা সাক্ষাৎ বা পরোক্ষ নয়, বরং প্রত্যক্ষ। সুফিরা সরাসরিভাবে আল্লাহর জ্ঞান পেতে চান। সংবেদনের মাধ্যমে আমরা যেমন বাহ্য জগতের জ্ঞান লাভ করি, অনুরূপে সুফির অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আল্লাহর জ্ঞান লাভ করেন। তবে সুফি অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। চোখ না থাকলে আমরা যেমন দেখতে পাই না, সুফি অভিজ্ঞতা সেরূপ নয়, বরং সুফি অভিজ্ঞতা যেকোন ইন্দ্রিয় মাধ্যম ছাড়া সরাসরি প্রত্যক্ষ করে। পার্থিব বস্তু আমরা প্রত্যক্ষণ করি। তবে এই প্রত্যক্ষণ ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষণ নয়, অন্তরের প্রত্যক্ষণ।
২. সুফি অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণধর্মী নয় : সুফি অভিজ্ঞতা কখনো বিশ্লেষণধর্মী নয়, বরং সংশ্লেষণধর্মী। এটি বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায় না। এটি খণ্ড খণ্ডভাবে জ্ঞানীর মনে উপস্থিত হয় না, বরং এ জাতীয় অভিজ্ঞতা অখণ্ড ও সমগ্রতা নিয়ে উপস্থিত হয়। বুদ্ধির মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞাতা-জ্ঞেয় সম্বন্ধ থাকে এবং জ্ঞাতা-জ্ঞেয় বস্তু সম্পর্কে সচেতন থাকে। কিন্তু সুফিদের ক্ষেত্রে এ ধরনের জ্ঞাতা জ্ঞেয় বস্তুর পার্থ ক্য থাকা অসম্ভব।
৩. সুফি অভিজ্ঞতা আত্মগত নয় : সুফি অভিজ্ঞতা আত্মগত নয়, বরং বিষয়নিষ্ঠ। এ ধরনের অভিজ্ঞতা আত্মগত হলে আমাকে নিজেদের সত্তা সম্পর্কে অবহিত হতে পারি না। ইকবাল বলেন, আমরা আমাদের সত্তা সম্পর্কে সচেতন। তবে অন্তদর্শন ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমে আমরা এটি জানতে পারি। কিন্তু অন্যের সত্তা বা অপরের মনকে জানবার জন্য স্বতন্ত্র কোন ইন্দ্রিয় নেই। কিন্তু আমরা নিজেদের দৈহিক সঞ্চালনের ভিত্তিতে অন্যের সচেতন সত্তার অস্তিত্বের অনুমান করি। সুতরাং সুফি অভিজ্ঞতা আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার শ্রেণির বহির্ভূত নয়।
৪. সুফি অভিজ্ঞতা ক্ষণস্থায়ী : সুফি অভিজ্ঞতা দীর্ঘস্থায়ী নয়; বরং ক্ষণস্থায়ী। একটি আলোকের ঝলকের মতো এটি সাধকের মনে প্রতিফলিত হয় এবং সাধক তৃপ্তি বোধ করেন। সে আলোকিত রশ্মিতে সুফির তন্ময়তা সাধারণ অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কিত। সুফি অভিজ্ঞতা লাভের পর সাধক পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করেন। তবে তন্ময়তার যে অভিজ্ঞতা তা সাধকের মনে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
৫. সুফির জ্ঞান স্বজ্ঞামূলক : সুফিদের জ্ঞান স্বজ্ঞামূলক। এ জ্ঞান সত্য ও বাস্তব। চিন্তার মাধ্যমে বাস্তব সত্তা একক ও অখণ্ডরূপে প্রতিভাত হয়। এদিকটির প্রতি লক্ষ্য রেখেই বার্গসো বলেন যে, স্বজ্ঞা চিন্তা বা বুদ্ধির এক উচ্চতর প্রকার। সুতরাং সুফিদের দিব্য দৃষ্টির জ্ঞান স্বজ্ঞামূলক।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুফিদের বীজ ইসলামের প্রারম্ভেই সূচিত হয়েছিল। হযরত মুহাম্মদ (স) প্রায়শই ধ্যানমগ্ন থাকতেন, আর সাহাবাগণ একনিষ্ঠভাবে তাকে অনুসরণ করে গেছেন। তাদের মধ্যে একদল ঘনিষ্ঠ সাহাবা বিশ্বাস গ্রহণের মুহূর্ত হতে ছিলেন মরমীতাবাপন্ন। তারা পার্থিব বিষয়ে উদাসীন এবং কদাচিৎ জাগতিক বিষয়ে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁরাই ‘আহলুস সুফফা’ হিসেবে পরিচিত। সুফিরা সহজ সরল পথে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য কঠোর সামনা করেন। সুতরাং মুসলিম দর্শনে সুফিবাদের বৈশিষ্ট্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87/