অথবা, সুফিবাদের উৎসসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সুফিবাদের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, সুফিবাদের সংজ্ঞা দাও। সুফিবাদের উদ্ভব সম্পর্কে লেখ।
অথবা, সুফিবাদ কাকে বলে? কোন কোন উৎস হতে সুফিবাদ উৎপত্তি লাভ করেছে তা আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : মুতাজিলাদের বুদ্ধিবাদ এবং হিজরি প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানদের মধ্যে বিকশি গঠনবাদীদের অন্ধ আকারবাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ইসলামে এক গূঢ় অতীন্দ্রিয় ভাবধারার উদ্ভব হয়, এটাই সুফিবাদ নামে পরিচিত। অতীন্দ্রিয় ভাবধারা সব সময়ে সব সমাজেই কম বেশি বিদ্যমান ছিল। আল্লাহ্ বা খোদাভীতি থেকেই ভাবধারার সৃষ্টি হয়। সুতরাং সুফিবাদ হচ্ছে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য আল্লাহ প্রেম ও ধ্যানের উপর গড়ে উঠা এক অতীন্তির মরমি ভাবধারা।
সুফিবাদ : সুফিবাদ এক প্রকার রহস্যময় আধ্যাত্মিক মতবাদ। সুফি ভাবধারার মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর গজ অনুভূতির অন্বেষণ ও আত্মার পবিত্রতা বিধান। মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন সাধন। সুফি সাধকেরা অন্তরের গভীর অনুভূতির দ্বারা আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চান। তাঁদের মতে, ন্যায়-নীতি, ভয়ভীতি, অপেক্ষা আন্তরিক ভালোবাসার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। সুফিরা অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে পরমসত্তাকে উপলব্ধি করেন। সুফিদের মতে, কেবল স্বজ্ঞার মাধ্যমেই আল্লাহকে পাওয়া যেতে পারে। আল্লাহর ধ্যান ও আল্লাহর প্রেম সুফিবাদের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সুফি দার্শনিক বিভিন্নভাবে সুফিবাদের সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন :
আবুল হুসাইন আন নূরির মতে, “যে মতবাদে ইন্দ্রিয়জ আত্মার সকল প্রবৃত্তিকে বিসর্জন দেয়ার কথা বলা হয়েছে তাই সুফিবাদ।”
জুনায়েদ বাগদাদি বলেন, “যে মতবাদে জীবন মৃত্যুসহ সকল বিষয় আল্লাহর উপর নির্ভরতার কথা বলা হয়েছে সে মতবাদই সুফিবাদ।”
সুতরাং সুফিবাদ এমন একটি মতবাদ যে মতবাদ ইসলামি শিক্ষার সে দিকটিই নির্দেশ করে, যেটিকে পারলৌকিক, বৈরাগ্যতা ও খোদা ভক্তির প্রতি অধিক জোর দেয়া হয়েছে।
সুফিবাদের উৎস : সুফিবাদ ইসলামের মতই প্রাচীন। ইসলামের আবির্ভাব হতেই সুফিবাদ উৎপত্তি লাভ করেছে। সুফিবাদের উৎস দুই প্রকার। যথা :
ক. অভ্যন্তরীণ উৎস এবং
খ. বহিঃস্থ উৎস।
ক. অভ্যন্তরীণ উৎস : সুফিবাদের উৎস বা উৎপত্তি সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায় ইবনে খালদুনের ‘মুকাদ্দিমা’ থেকে। ইবনে খালদুন বলেন, সুফিবাদ এমন একটি ধর্মীয় বিজ্ঞান, যার উৎপত্তি হয়েছে ইসলাম থেকে। সুফিবাদের অভ্যন্তরীণ উৎস প্রধানত দুই প্রকার।যথা :
১. কুরআন ও
২. হাদিস।
১. কুরআন : সুফিবাদের মূল উৎস হলো কুরআন। কুরআন এমন একটি ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে; যার সাথে প্রকৃত দর্শনের কোন বিরোধ নেই। প্রকৃত দর্শনের সাথে কুরআন শিক্ষার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে। পবিত্র কুরআন জ্ঞানানুশীলনের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে। কুরআনের মতে, মানুষই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ এবং জ্ঞানান্বেষণই মানুষের প্রধান কর্তব্য। কুরআন মানুষকে প্রাকৃতিক ঘটনাবলি, স্বর্গ-মর্ত্য, দিবা-রাত্র, গ্রহ-নক্ষত্র প্রভৃতি সম্পর্কে অনুধ্যান করতে উৎসাহ প্রদান |
২. হাদিস : কুরআনের মতো হাদিসও সুফিবাদের মূল উৎস। কুরআনের মতো হাদিসেরও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মহানবী (স) বলেছেন, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জ্ঞানার্জন করা অবশ্যই কর্তব্য। তিনি তার অনুসারীদেরকে সব সময় জ্ঞান ও সত্যানুসন্ধানের জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। কুরআনের মতো হাদিস ও দার্শনিক চিন্তার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। হাদিসেও কুরআনের মতো সুফিবাদের উপাদান পাওয়া যায়।
খ. বহিঃস্থ উৎস : অনেক পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ সুফিবাদের উৎপত্তি বহিঃস্থ উৎস থেকে হয়েছ
ে বলেও মনে করেন। এসব বহিঃস্থ উৎসগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. খ্রিস্টীয় উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ : অনেক পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ মনে করেন যে, ইসলামে খ্রিস্টীয় প্রভাব থেকেই সুফিবাদের উৎপত্তি হয়েছে। ভন ক্রেমারসহ অন্যান্য চিন্তাবিদরা বলেছেন, খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকদের সংস্পর্শে যখন মুসলমানরা আসে, তখন সুফিবাদের উদ্ভব ঘটে। তারা সরল জীবনের প্রতীক হিসেবে পশমী বস্ত্র পরিধান করতেন।
২. নব্য প্লেটোবাদ : সুফিবাদের উৎস সম্পর্কে অনেকে নব্য প্লেটোবাদের প্রভাবের কথা বলেছেন। তাদের মতে, সুফি অনুধ্যানমূলক জ্ঞানের ক্ষেত্রে হেলেনীয় প্রভাব রয়েছে। সুফিবাদে কিছু কিছু হেলেনীয় ভাবধারা থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে এটা বলা সংগত হবে না যে, সুফিবাদ সকল অনুধ্যানমূলক আলোচনা হেলেনীয় দর্শন থেকে এসেছে।
৩. পারসিক প্রভাব : পারসিক প্রভাবে সুফিবাদের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী চিন্তাবিদগণ মনে করেন যে, মুসলমানদের পারস্য বিজয় ছিল একটি উৎকৃষ্ট জাতির উপর অপর একটি নিকৃষ্ট জাতির আধিপত্য স্থাপন। পারসিকরা আরব মুসলমানদের চেয়ে একটি উন্নত জাতি বলে মনে করত। ফলে তাদের মধ্যে নৈরাশ্যবাদ এবং কৃচ্ছ্রবাদ দেখা দেয়।
৪. বৌদ্ধ প্রভাব : গলডিজিয়র বলেছেন, মুসলমানগণ জপমালা এবং ধর্মগ্রহণ পদ্ধতি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন । তাছাড়া মরমি তরিকায় মোকাম পদ্ধতি নির্বাণ আকারে ফানা মতবাদটিও বৌদ্ধিক প্রভাবে পরিলক্ষিত হয়।
৫. বেদান্ত প্রভাব : এম. মর্টেন (M. Morten) মনে করেন যে, বেদান্ত দর্শনের মায়াবাদের সাথে সুফিবাদের অনেকাংশে মিল রয়েছে। তাছাড়া ভারতীয় সন্ন্যাসী ও ঋষীদের নিরাসক্ত জীবন, কঠোর সংযম ও কৃচ্ছতাবাদী ভাবধারা মুসিলম সুফিদের জীবনে একটি গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মানুষ সামাজিক জীব। একজন সুফি সমাজে বাস করে। সমাজে বসবাসরত একজন সদস্য হতে সে অবশ্যই সামাজিক আচরণ করে। সুফি যেমন সমাজ হতে অনেক কিছু গ্রহণ করে তেমনি তাকে কিছু সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। সুতরাং সুফিবাদের অনুশীলনের প্রকৃতির ভিন্নতা থাকলেও সুফিবাদ যে কুরআন ও হাদিসের মূল শিক্ষা হতে এসেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।