সুফিবাদ কী? সুফিবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।

অথবা, সুফি দর্শন কাকে বলে? সুফিবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ তোমার নিজের ভাষায় লেখ।
অথবা, সুফিবাদের সংজ্ঞা প্রদানপূর্বক এর উৎপত্তি ও ত্রমবিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, সুফিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে যা জান তা আলোচনা কর।
উত্তর।। ভূমিকা :
ইসলামের ইতিহাসে যারা অতিপ্রাকৃত উপায়ে পরমসত্তা বা আল্লাহর সাথে একাত্মতা অর্জনে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তারা সুফি নামে পরিচিত। সুফিবাদের প্রধান লক্ষ্য হলো আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা। সুফিবাদ তাত্ত্বিক দিকের চেয়ে ব্যবহারিক দিকের উপর অধিক গুরুত্ব দেয়। সুফিরা গভীর ধ্যান মগ্ন অবস্থায় আধ্যাত্মিক জ্যোতি লাভ করেন। এ জ্যোতির সাহায্যে তারা সত্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য লাভ করেন। সুতরাং মুসলিম জাতির চিন্তাধারার মতো সুফিবাদ কুরআন ও হাদিসের শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত।
সুফিবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ : ইসলামে সুফিবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং এটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।সুফিবাদের উৎপত্তি সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, এটি কোন বৈদেশিক প্রভাবে নয়, বরং কুরআন ও হাদিসের অন্তর্নিহিত শিক্ষার ফলে এটি উৎপত্তি ও বিকাশলাভ করেছে। বলা হয় যে, যে মুহূর্ত থেকে মরমি আয়াতসমূহ নবী করীম (স) এর নিকট নাজিল হয়েছে, সে ক্ষণ হতেই এর উৎপত্তি হয়েছে। আর সেজন্য সুফিবাদ সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, Sufism is old as Islam. অর্থাৎ, সুফিবাদ ইসলামের মতোই পুরাতন ও প্রাচীন। ড. সৈয়দ নাদভি তাঁর ‘Muslim Thought and Its Source’ গ্রন্থে এ রূপ মন্তব্য করেন। বলা যায় যে, সুফিবাদের উৎপত্তি যে, ইসলামের মূল শিক্ষা হতে এসেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সুফিবাদ বিকাশের প্রাথমিক পর্যায় : প্রাথমিক যুগে খলিফাগণ জগতে ব্যস্ততম শাসক ছিলেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁরা নিজেদেরকে মরমি ভাবধারায় নিয়োজিত রাখতেন। সূচনাতে এ ধরনের মরমি ভাবধারা অল্পসংখ্যক মুসলমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ড. সৈয়দ এম নাদভি ‘Muslim Thought and Lts Source’ গ্রন্থে বলেন যে, হযরত উসমানের রাজত্বকালে এর পরবর্তীতে মুসলিম জগতে যে বিরাট বিপর্যয় ঘটে। তার ফলে মরমি ভাবধারার প্রসার হয়। এ বিপর্যয়ের ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে মরমি ভাবধারা তীব্রভাবে জাগিয়ে তোলে বলে তিনি মনে করেন এবং পরিণামে এ মতবাদ অগ্রগতির পথে এগিয়ে যায়। প্রথম মুসলিম যিনি মুসলিম বলে অবিহিত হতে থাকেন তিনি হলেন হাসান আল বসরী। আবার জামি কুফার আবু হাসিমকে প্রথম মরমি সাধক মনে করেন। বলাবাহুল্য গ্রিক, পারস্য, কিংবা আর্যদের প্রভাব ছিল না।
সুফিবাদ বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায় : সুফিবাদের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় মারুফ কারমির দ্বারা। তিনি ছিলেন সহজ, সরল ও খাটি সাধক। তার বক্তব্য হলো যে উত্তমরূপে আল্লাহকে জেনেছে, সে উত্তমরূপে তাঁর মধ্যে সমাহিত হতে পেরেছে। তাঁর মতে, ভাবোচ্ছ্বাস হচ্ছে জ্ঞান লাভ একমাত্র উপায়। মারুফ কারমি ছাড়াও বায়েজিদ বোস্তামী, যুন নুন মিশরী এ পর্যায়ের খাঁটি সুফি। আল গাজ্জালী এ পর্যায়ে ইসলামের যাহেরী ও বাতেনি দিকের সমন্বয়ে সুফিবাদকে পূর্ণতা দেন।
সুফিবাদের সর্বশেষ পর্যায় : ইসলামের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিকের পরস্পর বিচ্ছিন্নতা সুফিবাদের পতন ঘটায়, এটি শুরু হয় ১৩ শতাব্দীতে। এ যুগের মরমিগণ ইরাক, আরব, সিরিয়া, স্পেন, মিশর, মধ্য এশিয়া ও বাংলাদেশসহ সমগ্র পাক-ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। এ যুগের সুফিগণ ছিলেন আব্দুল কাদের জিলানী, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি, সোহরাওয়ার্দি, বাহাউদ্দিন নকশেবন্দ, মৌলানা, রূমি, নূর উদ্দিন জামি, ইবনুল আরবি স্পেনের প্রথম সুফি। তাঁর মতবাদ ওহেদাতুল ওজুদ নামে পরিচিত। তাঁর প্রভাব এত বেশি ছিল যে, বলা হয়ে থাকে পরবর্তী কোন সুফি আরবির প্রভাবমুক্ত হতে পারেননি। তবে আরবির অভূদিয়া মতবাদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ জন্ম লাভ করে তহুদিয়া রুকনউদ্দিন আলাউদ্দৌলা এর প্রতিষ্ঠাতা হলেও শেখ আহম্মদ সিরহিন্দ একে পুনরুজ্জীবন দেন। তিনি মোজাদ্দেদ ই আলফে সানি নামেও পরিচিত।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুফিবাদের উৎপত্তি হয় কুরআন ও হাদিনের মূল শিক্ষা হতে এবং তা বিকশিত হয় বিভিন্ন নিবেদিতপ্রাণ সাধকের সাধনার মধ্যে। কিন্তু সাহাবাদের মরমি ভাবধারা হতে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের অনুসারিগণ এ ধারা অব্যাহত রাখে। এ ধারা আল গজালির হতে পূর্ণতা পায়। মোটকথা, সুফিবাদের ক্রমবিকাশের ইতিহাস ও ইসলামের গৌরবের ইতিহাস।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87/