উত্তর : ভূমিকা : সুফি সাধকের জীবনের চরম ও পরম লক্ষ হলো আল্লাহর সান্নিধ্যে থেকে তার দীদার লাভ করা। এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য সুফিকে অনেক বাধা বিপত্তি পাড়ি দিতে হয় এবং সহ্য করতে হয় অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দুঃখ-কষ্ট। তারা পার্থিক জীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখ ও সম্পদের প্রলোভন থেকে মুক্ত করে নিজেকে মনুষ্যত্বের সাধনায় নিয়োজিত করেন। এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে পূর্ণমানর হতে হলে সুফিদের কতকগুলো মৌলিকনীতি অনুসরণ করে চলতে হয়।
→ সুফিবাদ : সুফিবাদ একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মূলকথা। পরম সত্তা মহান আল্লাহ কে জানার এবং আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যমে জানার প্রচেষ্টাকে সুফি দর্শন বা সুফিবাদ বলা হয়। হযরত ইমাম গাজালি (র.) এর মতে, “আল্লাহ্ ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্ েনিমগ্ন হওয়ায় নামই সুফিবাদ বলে।”
আল-কুশাইরী এর মতে, “বাহ্য ও অন্তর জীবনের বিশুদ্ধ তাই সুফিবাদ।” সুতরাং সুফিবাদ হচ্ছে এমন একটি মতবাদ যেখানে পার্থিব জীবনে সুখ ও সম্পদের প্রলোভন থেকে মুক্ত করে অনাড়ম্বর ও নির্লোভ জীবনাচারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়.
→ সুফিবাদের মূলনীতি : স্রষ্টা বা পরম সত্তার সাথে মিলনই করেন | সুফি সাধনার পরম লক্ষ। এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার জন্য
সময়ে | সুফিদের কতকগুলো মৌলিক নীতি মেনে চলতে হয়। নিচে
■ দিক | সুফিবাদের মূলনীতিগুলো আলোচনা করা হলো
১. আত্মসম্পূর্ণ : সুফিবাদের মূল উদ্দেশ্য হলো পরম সত্তার নিকট আত্মসমর্পণ। তাই তাদের পীর বা গুরুর নিকট কীর্তি | আত্মসমর্পণ করে তাদের শিক্ষা অনুযায়ী পথ চলতে হয়। তারা ত্যের | পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও নিয়ামত লাভ ফলে করার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
৩. যিকির : আল্লাহ্র নাম বা কুরআনের কোনো আয়াত বার বার আবৃত্তির নাম যিকির। এ যিকির নিরবে বা উচ্চ স্বরে দুইভাবে হতে পারে। যিকিরের মাধ্যমে পরম সত্তার সাথে লীন হতে হয়। কুরআনে বলা হয়েছে, “ফাযকুরুনী আযকুরুকুম” অর্থাৎ তুমি র | আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাকে স্মরণ করব। কুরআন ও হাদিসে যিকির করার উপর বহু আয়াতে জোড় দেওয়া আছে।
২. অতীন্দ্রিয় অনুভূতি : সুফি দর্শন অনুযায়ী অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমেই সাধক আল্লাহকে জানতে পারেন। অতীন্দ্রিয় অনুভূতি হলো এমন এক ধরনের অন্তর্দৃষ্টি, যার সাহায্যে সাধক ভূত-ভবিষ্যত, জগতের দৃশ্য, অদৃশ্য, আত্মা, আল্লাহ্ যাত ও সিফাতকে জানতে প্রয়াস পান।
৪. সামা বা সংগীত : আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রেমমূলক যে সংগীত যা আধ্যাত্মিক ভাচ তন্ময়তা জাগিয়ে তোলে তাই সামা। কোনো সুফি সাধক সামাকে ”রুহানী দোয়া” বা আত্মার আহার্য বলে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে সামা এর শ্রবণকারীকে আধ্যাত্মিক তে রাজ্যে টেনে নিয়ে যায় এবং মুহূর্তে সাধকের মনে আধ্যাত্মিক । ভাব জাগিয়ে তোলে। সাধারণত চিশতীয়া ও মৌলবীয়া তরিকার সুফিগণ সামা শ্রবণ করে থাকেন।
৫. হাল : হাল হলো সুফির এক ধরনের আধ্যাত্মিক মানসিক না | অবস্থা যা তার অন্তর্দৃষ্টি লাভে সাহায্য করে। হাল আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও অসীম দয়ার উপর নির্ভরশীল। হাল লাভ করার পর তাকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা সাধক করতে পারেন এবং যখন তা
দীর্ঘায়িত ও স্থায়িত্ব লাভ করে, তখন একে ‘মাকামাত’ বলা হয়।
■হাল সুফির আধ্যাত্মিক জীবনের এক চরম ও নিবিড় অভিজ্ঞতা।
৬. কৃতজ্ঞতা : সুফি সাধকরা সব সময় আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। প্রতিটি কাজের জন্য প্রতিটি ক্ষণের জন্য। সুফিরা মনে করেন, যা কিছু ঘটে তা মানুষের কল্যাণ
ের জন্য ঘটে। এই জন্য তারা সবক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
৭. পবিত্রতা : সুফি সাধকরা দুই ধরনের পবিত্রতা বজায় রাখেন। যেমন- (ক) দেহের পবিত্রতা ও (খ) অন্তরের পবিত্রতা। সুফি সাধকরা দেহ এবং মন পবিত্র রাখেন কারণ
অন্তরের পবিত্রতার উপর আল্লাহ্র জ্যোতি প্রতিবিম্ব হয়।
৮. ভক্তি বা প্রেম : সুফি সাধকরা ভয়ে নয়, প্রেমে আল্লাহ্র দীদার লাভ করেন। আল্লাহ্র প্রেমে সাধক জাগতিক সবকিছু ত্যাগ করেন। ভয়ে নয়, প্রেমের মধ্যদিয়ে আল্লাহর দীদার লাভ সুফিদের মূল লক্ষ্য।
৯. ফানা : আল্লার সঙ্গে সম্মিলনের নঞর্থক দিককে বলা হয় ফানা। যার অর্থ তিরোধান বা ধ্বংস, জাগতিক বিষয়ের সকল চাওয়া পাওয়ার অবসান। এই পর্যায়ে সাধকের নিজস্ব কোনো চাওয়া-পাওয়া থাকে না। একমাত্র আল্লাহ্কে ছাড়া সুফি এ সময় আর কিছুই চান না। আপন-পর, ভালো-মন্দ, সুনাম-
দুর্নাম কোনো কিছুতেই সাধকের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। এই পর্যায়ে সাধক জীবন্ত মৃত হয়ে যায়। যেটাকে বলে
মরার আগে মরা। আল্লাহ্র প্রেমের মরা।
১০. বাকা : বাকা হলো শেষ স্তর। ফানার শেষ, বাকার শুরু। আল্লাহ্র সাথে সম্মিলন অর্জনের সদর্থক দিকটি হলো বাকা। বাকার অর্থ হলো আল্লাহ্র স্বরূপে, গুণে প্রতিষ্ঠা লাভ করা। বাকাকে বলা হয় আল্লাহ্র মধ্যে অবস্থান। এ পর্যায়ে সাধক আল্লাহ্র চেতনার সাথে এক হয়ে যায়। সাধক এ স্তরে অমরতা লাভ করে চিরজীবী ও চিরঞ্জীব হন। এ সময় জীবন ও
মৃত্যু তার ইচ্ছাধীন হয়ে যায়। তিনি এ স্তরে প্রকৃত পক্ষে আল্লাময় হয়ে যান। তার সকল ইচ্ছা আল্লাহ্র ইচ্ছা হয়ে যায়, তার কর্ম হয়ে যায় আল্লাহ্র কর্ম।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলামের বাহিরের এবং ভিতরের রূপই হলো সুফি দর্শনের মূলনীতি। সুফি দর্শনের মূলনীতিগুলো পালন করলে একজন সাধক পূর্ণ মানব হয়ে যায়। এই মূলনীতিগুলো যথাযথভাবে পালন করলে একজন মানুষ আল্লাময় হয়ে উঠে। তাই আমাদের পার্থিব এবং অপার্থিব জীবনে শান্তির জন্য সুফিবাদের মূলনীতিগুলো অনুশীলন করা একান্ত প্রয়োজন ।