সুফিবাদের স্বরূপ ব্যাখ্যা কর। আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসায় সুফিবাদের গুরুত্ব আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : সুফিবাদ একটি ইসলামিক আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। আত্মা পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহ্র সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো সুফি দর্শনের মূলকথা। আর সুফি সাধকের জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য হলো আল্লাহ্র সান্নিধ্যে থেকে দীদার লাভ। এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য সুফিকে অনেক বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিতে হয় এবং সহ্য করতে হয় অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দুঃখ কষ্ট।
তারা পার্থিক জীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখ ও সম্পদের প্রলোভন থেকে মুক্ত করে নিজেকে মনুষ্যত্বের সাধনায় নিয়োজিত করেন।
সুফিবাদের স্বরূপ : সুফিবাদ একটি আধ্যাত্মিক দর্শন। আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করাই এর মূল লক্ষ্য। নিচে সুফিবাদের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হলো-
১. অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে গুরুত্বারোপ : প্রত্যেক মানুষকে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের জ্ঞান আরোহণ করতে হয়। কিন্তু সুফি সাধকরা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের জ্ঞান আরোহণ করে নিজেকে পরিতৃপ্ত মনে করেন না। তারা সজ্ঞাজনিত জ্ঞানের উপর অধিক পরিমাণে ঝুঁকে থাকেন। এজন্য তারা অতীন্দ্রিয় অনুভূতিকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
২. আল্লাহর দর্শন : আমরা বাহ্যিক দিক থেকে অনেক জ্ঞান লাভ করি। আর সুফিরা লাভ করেন আল্লাহ্র জ্ঞান। সুফিরা সুফি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আল্লাহ্র জ্ঞান লাভ করে থাকেন। আমরা যেমন পার্থিব বিভিন্ন জিনিস প্রত্যক্ষণ করে থাকি তেমনি সুফিরা আল্লাহকে প্রত্যক্ষণ করে থাকে। তবে এই প্রত্যক্ষণ হলো অন্তরের দর্শন।
৩. আধ্যাত্মিক মতবাদ : সুফিবাদ হলো এক ধরনের আধ্যাত্মিক মতবাদ। এ মতবাদের মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা। সুফিবাদের সাধনা হলো পার্থিব জীবনের দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, জ্বালা যন্ত্রণা না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, এবং সর্বময় মমতার বন্ধন ছিন্ন করে এক আল্লাহর সাথে মানবাত্মার মিলন ঘটানো।
৪. আন্তরিক ভালোবাসা : সুফি সাধকরা মনে করেন যে, ভয়ভীতি দিয়ে আল্লাহকে অর্জন করা যায় না। তাকে অর্জন করতে হয় অন্তরের ভালোবাসা দিয়ে। এজন্য সুফি সাধকগণ ন্যায় নীতি ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করেন।
৫. সুফি অভিজ্ঞতা : সুফি অভিজ্ঞতা যুক্তি, বিশ্লেষণধর্মী বা ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান নয়। এ জ্ঞান স্বতন্ত্র জ্ঞান, এ তাদের হৃদয়েরnউপলব্ধ জ্ঞান, এ জ্ঞানকে বলা হয় কাশফের জ্ঞান। উচ্চ পর্যায়ে সুফি অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করা কঠিন কাজ তবে এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুটা জানা যায় ।
৬. বস্তুনিষ্ঠতা : সুফি অভিজ্ঞতা হলো একটি জ্ঞানের গভীর অনুভূতি। এ অনুভূতি পার্থিব ও অপার্থিব জগতের মধ্যে পার্থক্য ঘটিয়ে
মানব সত্তাকে একটি স্বর্গীয় সত্তায় মিশাতে সহায়তা করে। বিষয়বস্তুর বিবেচনায় এ অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ রূপে বস্তুনিষ্ঠ বলে মনে হয়.
৭. একত্ব ধারণা : সুফিয়া জীবন ধারণের জন্য একত্ব ধারণা পোষণ করে। তারা সমস্ত জগতে একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করতে পারে না। তারা মনে করেন যে, জীবনের সফলতা এবং পরকালের মুক্তি একমাত্র কোনো মানুষের আল্লাহর হাতেই বিদ্যমান। সুফিয়া তাদের একত্ব বিশ্বাসকে মূল চালিকা হিসেবে কাজ করে।
৮.বিচার- . চিন্তা বা বুদ্ধি বিচার-বিশ্লেষণ : সুফিবাদে চিন্তা বা বুদ্ধির বিশ্লেষণের কথা বলা হয়েছে। জ্ঞান বা বুদ্ধি মানব সত্তাকে জানতে চেষ্টা করে। সুফিদের মতে, জ্ঞান হলো সকল গুণের। আধার। এই জ্ঞান আরোহ পদ্ধতি প্রাপ্ত জ্ঞান থেকে পৃথক। এই জ্ঞান দ্বারা বিভিন্ন সত্তাকে বিশ্লেষণ করা যায়।
৯. ধৈর্য ধারণ বা আত্মসংযম : সুফি সাধকরা আত্মসংযমী হন। তারা কঠিন বিপদের সময়েও ধৈর্য ধারণ করেন। ধৈর্য তাদের একটি গুণ। তারা বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে লোকজনকে। ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দেন।
১০. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ : সুফি সাধকরা সবসময় আল্লাহ্র উপর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তারা মনে ক রেন জগতে সকল কাজের মধ্যে ভালো গুণ আছে। জীবনে কখনো কোনো বিপদ
আসলে তারা মনে করেন যে, এর পরবর্তী ফল হয়তো ভালো। হবে এই বলে তারা আল্লাহ্র প্রতি-কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। নতুন
→ আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসায় সুফিবাদের গুরুত্ব : আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসায় সুফিবাদের গুরুত্ব অত্যাধিক। বিজ্ঞানের নতুন
আবিষ্কার মানব জীবনকে যেমন করেছে সহজলভ্য তেমনি মানুষ জলে-স্থলে-অন্তরীকে প্রতিষ্ঠা করেছে একচ্ছত্র আধিপত্য। চন্দ্র, মঙ্গল, প্রভৃতি গ্রহ উপগ্রহের নভোমঙ্গলে নির্ভীক গতিবেগে ছুটে চলেছে বৈজ্ঞানিক সাফল্য। তবে ব্যক্তিগত দৈনন্দিন জীবনে
ও বিজ্ঞানের দান অপরিসীম। তথাপি বিজ্ঞানের এই সাফল্য মানুষের জীবনে শান্তি, সুখ এনে দিতে পারেনি। মানুষ হয়ে পড়েছে জড়বাদী ও বস্তুতান্ত্রিক। মানুষের আজ প্রধান ধর্ম পঞ্ ইন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তি। মানুষের পুনাঙ্গ মূল্যবোধের সাথে যুক্ত হয়েছে তার দৈহিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যত্মিক মূল্যবোধ।
এটাকে বাদ দিয়ে মানব জীবনের পূর্ণ চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়। মানব জীবনের পরিপূর্ণ উপলব্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য
উপাদান হলো দেহের সাথে মন ও আত্মার অনুশীলন। জড়বাদ মানুষকে একটি বিরাট শূন্যতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই
শূন্যতা থেকে একমাত্র তাসাউফ মানব জাতিকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। মানুষের দেহের সাথে মনের এবং মনের সাথে
আত্মার সংযোগ স্থাপন তাই একান্ত অপরিহার্য এবং তার নিশ্চয়ত বিধান একমাত্র সুফি দর্শনই দিতে পারে। বর্তমানে জড়বাদের কুয়াশাচ্ছন্ন বিশ্বে অশান্তি, যুদ্ধ, বিগ্রহ,
হিংসাদ্বেষ, সংশয়, ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। আর মানুষ যেন সেই আপত মধুর গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। পথ হারা মানুষের মতো মানুষ যেন দিগ্বিদিক ছুটছে। সব কল্যাণ, সব সুন্দর মূল্যবোধকে মানুষ যেন গলাটিপে হত্যা করেছে। আধুনিক জীবন যেন হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। এসব থেকে রক্ষা করে
মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে আসতে পারে একমাত্র সুফিদর্শন। আমাদের আধুনিক জীবনে সুফিবাদের মূলনীতিগুলো সঠিক ও
সুন্দর পথের পরিচায়ক হিসেবে কাজ করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক জীবনে সুফিবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। মানব জীবনকে রক্ষা করার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র সুফিদর্শনের। সুফিবাদ মানুষের আধ্যাত্মিক মুক্তির একটা অনিবার্য উপায়। তাই আমাদের পার্থিব ও অপার্থিব জীবনে শান্তির জন্য সুফিবাদের চর্চা করা একান্ত অপরিহার্য।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%86/