সুফিদর্শনের সৃষ্টিতত্ত্ব আলোচনা কর।

অথবা, সুফিবাদ অনুসারে সৃষ্টিতত্ত্ব সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
অথবা, সুফি সৃষ্টিতত্ত্ব কী?
অথবা, সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে সুফিদের অভিমত সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, সুফি সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে যা জান লেখ।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
মানুষের মরমি প্রবণতা তথা পরম সত্তার সাথে একাত্মবোধের বাসনা স্বাভাবিক প্রবৃত্তিজাত আর এ বাসনার তাগিদেই মানুষ জগৎসংসার সবকিছু ত্যাগ করে একমাত্র পরম সত্তার দিদার লাভের পথে আত্মোৎসর্গ করেন। ইসলামের এ মরমি দিকটিই তাসাউফ বা সুফিবাদ নামে পরিচিত। আর সুফিবাদী দর্শনে যেসব তত্ত্বের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে করা হয় তন্মধ্যে সৃষ্টি তত্ত্ব অন্যতম।
সুফি সৃষ্টিতত্ত্ব : নানা বৈচিত্র্য ও রহস্যাবৃত্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি কৌশল চিন্তাশীল মানুষ মাত্রকেই ভাবিত করেছে সেই সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই। জগৎ জীবনের অপার রহস্য মানুষের চিন্তা চেতনাকে করেছে বিস্মিত এবং মানুষকে তাড়িত করেছে অজানাকে জানার মোহে। আর এই বিস্ময় থেকে উদ্ভূত তাত্ত্বিক আলোচনাই চিন্তার জগতে সৃষ্টি তত্ত্ব নামে পরিচিত। কেবল চিন্তাশীল মননশীল বিজ্ঞান ও দর্শনে নয় ধর্মেও বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে সমভাবে। সৃষ্টি তত্ত্বানুসারে আদিতে এমন এক সময় ছিল যখন ঈশ্বর বা স্রষ্টা ছাড়া আর কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। ঈশ্বর বা আল্লাহ অনাদি অনন্ত সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বগুণান্বিত। এ সর্বশক্তিমান আল্লাহই সৃষ্টির আদি কারণ, সমগ্র বিশ্বের নিয়ামক সরকারের নিয়ম শৃঙ্খলার ধারক, বাহক ও নিয়ন্ত্রক, অনন্ত অনাদিকাল থেকেই তিনি বিরাজমান,
তাঁর কোন অভাব অভিযোগ বা সীমাবদ্ধতা নেই। তথাপিও ঈশ্বর কোন এক বিশেষ মুহূর্তে আপন ইচ্ছায় এক আকস্মিক আদেশ বলে সৃষ্টি করলেন এই বিশ্বজগৎ। অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহ কোন অভাববোধ বা সীমাবদ্ধতা থেকে নয়, শুধু তাঁর অন্তর্নিহিত আনন্দ উপভোগের ইচ্ছায় সৃষ্টি করলেন এ বিশ্বজগৎ। সুফিবাদ ইসলাম ধর্মের অনুসরণে সৃষ্টিতত্ত্বের এ ব্যাখ্যাকেই গ্রহণ করেন। সুফিবাদ অনুসারে স্রষ্টার আনন্দ থেকেই সৃষ্টির সূচনা। জগৎ সৃষ্টি হয়েছে পরম স্রষ্টা আল্লাহর ইচ্ছায়। তিনি ইচ্ছা করলেন ‘হয়ে যাও’ আর অমনি জগৎ সৃষ্ট হয়ে গেল। তাঁরা মনে করেন, সৃষ্টির আদিতে আল্লাহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আল্লাহর কোন আকার ছিল না। তিনি ছিলেন অন্ধকারবৃত্ত। নিজের অজ্ঞাতেই তিনি নিজের নূরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজ প্রতিরূপ একনূরের সৃষ্টি করেন। এই নূর হলেন নূরে মুহাম্মদী বা নূরনবী। অর্থাৎ নূরনবী হলেন আল্লাহর সত্তাসারের প্রতিরূপে সৃষ্ট নূরসত্তা, বাংলার সুফিদের মতে, আল্লাহ একমাত্র পরম সত্য, “আল্লাহ নূরের শ্রেষ্ঠ নূর।” নবী বলেন “আমি নূর আল্লাহর নূর হতে সৃষ্ট।” সুফিরা মনে করেন, নূরনবীর সৃষ্টির কারণেই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়। নূরনবী সৃষ্টি না হলে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হতো না। এ নূরনবী হতেই দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের সবকিছুর সৃষ্টি। আল্লাহ স্রষ্টা হিসেবে সৃষ্টিকার্য পরিচালনা করেন। আল্লাহ নূরে মুহাম্মদী থেকে চার ফেরেস্তা সৃষ্টি করেন। এরপর তিনি মৃত্যু চৈতন্য, প্রেম, প্রজ্ঞা, চিন্তা ও সাহস সৃষ্টি করেন। পরে ‘কুন’ শব্দের মাধ্যমে মানুষের আত্মা সৃষ্টি করেন। এভাবে নূরে মুহাম্মদী থেকে সব কিছুর সৃষ্টি হয়। এভাবেই বাংলার
সুফিরা নূরনবী তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্বের উৎপত্তি বা সৃষ্টি ব্যাখ্যা করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, সুফিবাদ মূলত ইসলাম ধর্মের ব্যাখ্যাত সৃষ্টি তত্ত্বকে তত্ত্বের ব্যাখ্যা ধর্ম থেকে উৎসারিত বলে অনেকেই তাঁদের এ তত্ত্বকে যুক্তিভিত্তিক নয় বলে মনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ হুকুম করলেন ‘হয়ে যাও’ এমনিই শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়ে গেল। কিন্তু শূন্য থেকে কোন কিছু সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুফি সৃষ্টি তত্ত্বের গুরুত্ব একেবারে অনস্বীকার্য নয়। কেননা, সাধারণ মানুষের প্রত্যাহিক জীবন বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে ধারণ করেই এ মত বিকাশ লাভ করে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87/