অথবা, সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের অসুবিধা আলোচনা কর।অথবা, সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের নেতিবাচক দিকসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজস্ব সংবিধান থাকে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচাি সরকারের রূপ সংবিধানের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। সরকার ও জনগণের মধ্যে কি সম্পর্ক থাকবে তাও সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত হয়। সংবিধান হলো রাষ্ট্রের সেসব বিধিবদ্ধ নিয়ম ও নীতিমালা, যা দ্বারা রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হন। একটি রাষ্ট্রে সংবিধান সরকারের সৃষ্টি নয়, বরং সরকারই সংবিধানের সৃষ্টি। সংবিধানের যেসব শ্রেণিবিভাগ রয়েছে তার মধ্যে সুপরিবর্তনীয় সংবিধান অন্যতম।
সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের দোষসমূহ বা নেতিবাচক দিক (Demerits of flexible constitution) : সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের উপর্যুক্ত আপেক্ষিক গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও এর কতকগুলো ত্রুটি বা নেতিবাচক দিক রয়েছে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
১. অস্থায়ী: অস্থিরতা হল অপরিবর্তনীয় সংবিধানের প্রধান ত্রুটি। কারণ এটি পরিবর্তন করা সহজ, সরকার তার নিজের স্বার্থে বা বিরোধী দল বা চাপ গোষ্ঠীর দাবির মুখোমুখি হতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই জাতীয় সংবিধান পরিবর্তন করে। ফলস্বরূপ, ঘন ঘন পরিবর্তন এর স্থায়িত্ব এবং মৌলিকতা ধ্বংস করে। তাই সংস্কারযোগ্য সংবিধানে স্থিতিশীলতার অভাব পরিলক্ষিত হয়।
২. জনগণের আস্থা কম: অপরিবর্তনীয় সংবিধান সহজে পরিবর্তন করা যায়, তাই কোন সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় না। আইনের শাসন আজ জারি করা হয় এবং কাল আবার পরিবর্তন হয়। যে কারণে জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
৩. মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত নয়: সুসংশোধিত সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করার সুযোগ সংবিধান হস্তগত করে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সহজেই খর্ব করা বা সীমিত করা যায়। ফলে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হয়। তদুপরি, মৌলিক অধিকারগুলি সংশোধনযোগ্য সংবিধানে সংরক্ষিত নেই।ফলে মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে না।
৪. বিভাগীয় হস্তক্ষেপের আশঙ্কা: সংস্কারযোগ্য সংবিধানে বিচার বিভাগের প্রাধান্য রয়েছে, তাই সরকারের এই বিভাগটি কোনো বিভাগের উপর অযথা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে পারে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের হাতে সময় স্বল্পতা ও বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে। তাছাড়া সরকারের সকল বিভাগের ক্ষমতা এই সংবিধানে লিপিবদ্ধ নেই। ফলে এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
৫. স্বচ্ছতা এবং নির্দিষ্টতার অভাব সংশোধনযোগ্য সংবিধান সাধারণত অলিখিত এবং স্বচ্ছতা ও সুনির্দিষ্টতার অভাব রয়েছে। ফলে মানুষ তাদের অধিকার বা কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন নাও হতে পারে।
৬. সংবিধানের মর্যাদা ক্ষুণ্ন: সংবিধান দেশের মৌলিক আইন। এই আইন অন্যান্য আইন পরিচালনা করে। সুতরাং এটাই সমস্ত দেশে এটি বিশেষভাবে পবিত্র এবং মর্যাদাপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু সংশোধিত সংবিধান ও সাধারণ আইনের মর্যাদার মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।
৭.যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অনুপযোগী : সুপরিবর্তনীয় সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার উপযোগী নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দু’ধরনের সরকার থাকে এবং এ দু’ধরনের সরকারের মধ্যে নির্দিষ্টভাবে সংবিধানে ক্ষমতা বণ্টিত থাকে। তাই লযুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান সুপরিবর্তনীয় হওয়া বিধেয়। তাহলে কোন সরকারই সহজে সংবিধান সংশোধন করে অপর সরকারের ক্ষমতা সংকুচিত এবং নিজের ক্ষমতার পরিধিকে সম্প্রসারিত করতে পারে না। কিন্তু সুখরিবর্তনীয় সংবিধানে তা হয় না। তাই এ ধরনের সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অনুপযোগী।
৮. জনস্বার্থ অবহেলিত সুপরিবর্তনীয়: সংবিধান হলো অত্যন্ত নমনীয়। তাই ক্ষমতাসীন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা সমাজের প্রভুত্বকারী শ্রেণি সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে বা শ্রেণি স্বার্থে শাসনতন্ত্র সংশোধন করতে পারে। এর ফলে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ অবহেলিত হয়।
৯. অহরহ বা ঘন ঘন পরিবর্তন: সহজে পরিবর্তনশীল হওয়ার জন্য কারেমি শাসকচক্র জনগণের দোহাই দিয়ে। ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য অহরহ সংবিধান পরিবর্তনের জন্য অগ্রহী হয়। ফলে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের খেয়ালখুশীও অধিক মাত্রায় চরিতার্থ হয়। অনেক সময় সামান্য বা বিনা কারণে পরিবর্তনের জন্য অগ্রসর হতে দেখা যায়।
১০. দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেয়: সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের নমনীয় চরিত্রের কারণে শাসকশ্রেণীকে এর মর্যাদাবোধ রক্ষা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য তেমন সচেতন ও দায়িত্ব গ্রহণ করতে উৎসাহী করে না। এরূপ সংবিধান সরকার বা বিরোধী দলকে দায়িত্ববান হতে সাহায্য করে। সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে জনগণের সকল অধিকার ও কর্তব্য অলিখিত থাকে। ফলে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনাবোধও জামাত হয় না।
১১. দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের প্রতিবন্ধক: সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের অধীনে দীর্ঘমেয়াদি সরকারি পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে কার্যকরী করার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। এতে একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাহত হয়।
১২. দুর্বল বিচার বিভাগ : সংবিধান সুপরিবর্তনীয় হলে বিচার বিভাগ দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ নমনীয় সংবিধানের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতার সৃষ্টি হলে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা দূর করার ক্ষেত্রে আদালত অসুবিধায় পড়ে। নমনীয়তার কারণে সুপরিবর্তনীয় শাসনতন্ত্র ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং জনগণের শ্রদ্ধা হারায়।
উপসংহার: পরিশেষে সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের দোষসমূহ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বর্তমান বিশ্বের শাসনব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, অধিকাংশ দেশেই এরূপ সংবিধান গৃহীত হয় নি। কারণ সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে ইতিবাচক দিকের চেয়ে নেতিবাচক অংশের প্রভাবই বেশি। তা সত্ত্বেও সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের গুরত্বকে অস্বীকার করা যায় না। বর্তমান বিশ্বে ইংল্যান্ড সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের অন্যতম ধারক ও বাহক। লর্ড ব্রাইস(Lord Bryce) এর ভাষায় বলা যায়, “Flexible constitution bends but does not break.