অথবা, সুদের হার শূন্য হতে পারে কি? আলোচনা কর।
উত্তর : যখন কণের বিপরীতে আসলের সাথে অতিরিক্ত কোন অর্থ প্রদান করতে হয় না তখন শূন্য সুদের হার বলে। তত্ত্ব মতে ঋণের চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি হলে এক পর্যায়ে সুদের হার শূনো নেমে আসতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মূলধন বাজারে সুদের হার উঠানামা করলেও তা কখনও শূন্যে নেমে আসে না। কারণ সুদের হার কমতে থাকলে আবার ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন সুদের হার আবার বাড়তে থাকে। তাই বাস্তবে সুদের হার কখনো শূন্য হতে পারে না। নিম্নে তা উপস্থাপন করা হলঃ
১. উৎপাদনশীলতা: উপকরণের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা শূন্য হলে দামও শূন্য হবে এ যুক্তি সুদের ক্ষেত্রে খাটে না। সুদের হার শূন্য হতে পারে কিনা তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মনে প্রশ্ন জাগে। কিন্তু গতিশীল অর্থনীতিতে মূলধনের প্রান্তি ক দক্ষতা শূন্য হতে পারে না।
২. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ সুদের হারকে শূন্য হতে দেয় না। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতাকে যথেষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই সুদের হার শূন্য হতে পারে না।
৩. গতিশীল অর্থনীতিঃ গতিশীল অর্থনীতিতে মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা শূন্য হতে পারে না। তাই সুদের হারও শূন্য হতে পারে না। সুদের হার শূন্য হতে পারে না এ প্রসঙ্গে যারা যুক্তি দেখান, মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা কেবল স্থিতিশীল অর্থনীতিতে কমতে কমতে শূন্য হতে পারে। কিন্তু গতিশীল অর্থনীতিতে এরূপ ভাবনার কোন কারণ নেই। গতিশীল সমাজ বলতে সেই অবস্থাকে বুঝায়, যেখানে নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন যেমন আছে, তেমনি আছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এসব গতিময়তার প্রেক্ষিতে মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা শূন্য হতে পারে না।
৪. ধনাত্মক সঞ্চয়: ধনাত্মক সঞ্চয় থাকতে হলে সুদের হার শূন্য হতে পারে না। বিনা সুদে মানুষ সঞ্চয় করতে চায় না। এমতাবস্থায় মূলধনের যোগান বজায় রাখতে হলে সুদ কিছু না কিছু থাকতে হবে। দেশের সমস্ত আয় যদি ভোগের ক্ষেত্রে ব্যয়িত হয়, তবে সঞ্চয় হতে পারে না। আর সঞ্চয় না হলে, মূলধন বা ঋণের কোন প্রশ্ন ওঠে না। এমতাবস্থায় সুদ নামক বিষয়টিই থাকতে পারে না। কাজেই ধনাত্মক সঞ্চয় থাকতে হলে সুদের হার শূন্য হতে পারে না।
৫. ঋণদানকারীর প্রত্যাশা: ঋণদানকারীরা তাদের প্রত্যাশার শূন্য পর্যায়ে নেমে যাবে, তা কখনও হতে পারে না। কাজেই সুদের হার দর্পনও শূন্য হতে পারে না।
৬. সময় পছন্দঃ সময়-পছন্দের জন্য সমাজে সুদের অস্তিত্ব থাকবে। প্রত্যেক মানুষের নিকট ভবিষ্যৎ তৃপ্তির তুলনায় বর্তমান তৃপ্তি অধিকতর আকর্ষণীয়। এই কারণে মানুষ সহজে বর্তমানকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যতের সঞ্চয় করতে চায় না। সুতরাং যতদিন মানুষের এ মনোভাব বজায় থাকবে ততদিন সঞ্চয়ে উৎসাহ প্রদানের জন্য সুদ দিতে হবে।
৭. নগদ পছন্দঃ নগদ পছন্দের কারণেও সুদের হার শূন্য হতে পারে না। মানুষ নগদ টাকা হাতছাড়া করতে চায় না। তাই নগদ টাকা হাতছাড়া করার অনিচ্ছা দূর করে মানুষকে সঞ্চয়ে রাজি করাতে হলে পুরস্কার হিসেবে সুদ দিতে হবে।
৮. অর্থের যোগান ও চাহিদা:মূলধনের যোগান এর চাহিদার চেয়ে বেশি হলে সুদের হার শূন্য হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে মূলধনের যোগান কখনই মূলধনের চাহিদাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। কারণ আয় বৃদ্ধির ফলে মানুষের চাহিদার বৈচিত্র্য বাড়ে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মোট চাহিদা বাড়ে। মূলধনের যোগান মানুষের চাহিদাকে অতিক্রম করে, এরূপ সম্ভাবনা কম।
৯. তারল্য ফাঁদ: তারল্য ফাঁদ ধারণাটি সুদকে শূন্য হতে দেয় না। তারল্য পছন্দের ফলে সুদের হার কখনও শূণ্যেতে পরিনত হতে পারে না। কেইনসের মতে, “স্বল্প সুদের হার তারল্য পছন্দ অসীম স্থিতিস্থাপকতায় অর্থাৎ তারল্য ফাঁদে পৌঁছায়।
সুদের হার কখন শূন্য হবেঃ
“১. যদি মানুষের মোট আয়ের সম্পূর্ণ অংশ ভোগের ক্ষেত্রে ব্যয় হয়, তখন সঞ্চয় ও বিনিয়োগ শূন্য হয়। এরূপ অস্বাভাবিক অবস্থা থাকলে সুদের হার শূন্য হতে পারে।
২. সমাজে মূলধনের যোগান যদি চাহিদা অপেক্ষা অতিমাত্রায় থাকে, তখন মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা শূন্য হতে পারে। সেরূপ অবস্থায় সুদের হার শূন্য হয়।
উপসংহার: বর্তমান সমাজের বাস্তব পরিস্থিতিতে বলা যায়, সুদের হার হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা থাকলেও বড়জোর ন্যূনতম স্তরে এসে পৌঁছতে পারে। কিন্তু সুদের হার কখনও শূন্য হতে পারে না।