অথবা, সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কে ম্যাক্স ওয়েবারীয় দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক স্তরবিন্যাস ও ম্যাক্স ওয়েবারের তত্ত্ব পর্যালোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : কার্ল মার্ক্স ও ম্যাক্স ওয়েবার সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কিত তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পেয়েছেন এবং তাদের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। এখানে আমাদের আলোচনার বিষয় হলো সামাজিক স্ত রবিন্যাস সম্পর্কে ম্যাক্স ওয়েবারের দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি শ্রেণি, পদমর্যাদা এবং রাজনৈতিক দল নামক তিনটি প্রত্যয়কে ভিত্তি করে স্তরবিন্যাসকে ব্যাখ্যা করেছেন।
ম্যাক্স ওয়েবারের মূলবক্তব্য : সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কিত মার্কসীয় চিন্তার অনেক দিক সম্পর্কে ওয়েবার অভিন্ন মত পোষণ করেছেন। ওয়েবার সামাজিক স্তরবিন্যাস বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আরো বেশি জটিল ও বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিয়েছেন। মার্ক্সের মতো ওয়েবারও সামাজিক স্তরবিন্যাসের জন্য অর্থনৈতিক বিভিন্ন উপাদানের উপর গুরুত্ব
দিয়েছেন । এনথনি গিডেন্স (Anthony Giddens) বলেছেন, “Weber’s approach to stratification was built on the analysis developed by Marx, but he modified and elaborated it.” মার্ক্স ও ওয়েবার উভয়ের মতেই সম্পত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, সুযোগ সুবিধা ও সফলতা আনয়ন করে।
ওয়েবার সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন ক্ষমতা ও সম্পদের ভিত্তিতে। তিনি তাঁর সামাজিক স্তরবিন্যাস তত্ত্বের ব্যাখ্যায় শ্রেণির সাথে আরো দুটি প্রত্যয় যুক্ত করেছেন- ১. মর্যাদা (Status) এবং ২. দল (Group)। এ দুটি প্রত্যয় পরস্পর সম্পর্কযুক্ত যেগুলো সমাজে স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। যেমন-
ক. সম্পত্তির পরিমাণের বিভিন্নতা বিভিন্ন শ্রেণির জন্ম দেয়।
খ. খ্যাতির উপর ভিত্তি করে অসম মর্যাদা গোষ্ঠীর সূচনা হয়।
গ. ক্ষমতার বিভিন্নতা সমাজে নানা দলের সৃষ্টি করে।
ওয়েবার দেখিয়েছেন, সামাজিক স্তরবিন্যাসের উপাদানগুলো কিভাবে সামাজিক অবস্থান তৈরি করে। তিনি মর্যাদা গোষ্ঠীর ধারণা নিয়েছেন সামন্ততান্ত্রিক এস্টেট ব্যবস্থা থেকে। মর্যাদা দ্বারা সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে সম্মানের পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। তবে এ সামাজিক সম্মান ইতিবাচক ও নেতিবাচক হতে পারে। মার্ক্স মনে করতেন যে, কোন আর্থিক শ্রেণির সদস্যরা ক্রমে স্বার্থ ও অধিকার সচেতন শ্রেণিতে পরিণত হয়। কিন্তু
ওয়েবার বলেন, অনেক সময় আর্থিক শ্রেণি আত্মসচেতন গোষ্ঠীতে পরিণত হয় না, বরং একই পদমর্যাদাবিশিষ্ট শ্রেণির লোকেরা একটি সুসংহত আত্মসচেতন শ্রেণিতে রূপ নেয়। সমমানের খ্যাতি ও সম্মানের ভিত্তিতে মর্যাদা গোষ্ঠীর সৃষ্টি হতে পারে। কেবল সম্পত্তির পরিমাণের ভিত্তিতে সম্মান ও খ্যাতির পরিমাণ নির্ণয় করা যায় না। অর্থাৎ হঠাৎ সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার মানে এই নয় যে, সে বেশি মর্যাদার অধিকারী হয়ে গেল। আবার অনেক অভিজাত পরিবার তার অর্থ বিত্ত হারিয়ে দরিদ্র বা নিঃস্ব হয়ে গেলেও সমাজে তাদের মর্যাদা বা চালচলনে আভিজাত্য বজায় থাকে। তার জীবনযাত্রার ধরনের এবং সামাজিক মেলামেশায় পূর্বের ঐতিহ্য বজায় রাখে। ওয়েবার তাঁর তত্ত্বে বলেন, প্রাচীন সমাজে কোন ব্যক্তির কাজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সমাজে তার মর্যাদা নির্ধারিত হতো। কিন্তু আধুনিক সমাজে ব্যক্তির জীবনযাত্রার মানের উপর ভিত্তি করে তার মর্যাদা ও সম্মান নির্ধারিত হয়। যেমন- কোন ব্যক্তির গাড়ি, বাড়ি, পেশা, পোশাক সমাজে তার মর্যাদাকে নির্ধারণ করে। একই মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিরা একটা স্বতন্ত্র ও ভিন্ন শ্রেণি গড়ে তোলে। ওয়েবার আরো বলেন, সম্পত্তির বিভিন্নতা জীবনে আচার আচরণে পরিবর্তন আসে এবং জীবনে সুযোগ সুবিধা আনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রকৃতপক্ষে অর্থের পরিপূরক হিসেবে শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, রুচি ইত্যাদি যুক্ত না হলে কেউ মর্যাদার অধিকারী হতে
পারে না। ওয়েবার সামাজিক স্তরবিন্যাসের অন্য আর একটি দলের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে দল গঠনে ক্ষমতার একটি ভূমিকা রয়েছে। দল বলতে তিনি বুঝিয়েছেন এমন একটা জনসমষ্টিকে যারা একত্রে কাজ করে, যাদের একটি সাধারণ পটভূমি রয়েছে এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং স্বার্থ রয়েছে। মূলত কোন ব্যক্তি বা শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থান, মর্যাদা ও দলের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। তিনি বলেন যে, একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি বা মর্যাদার উপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন দল গঠিত হওয়ার আশঙ্ককা কম, বরং কোন একটা দলে ভিন্ন শ্রেণি বা গোষ্ঠীর লোক বেশি থাকবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপেক্ষিতে বলা যায় যে, ওয়েবার সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কে তার তত্ত্বটি সুন্দর ভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি এ তত্ত্বের মাধ্যমে সামাজিক স্তরবিন্যাসকে সুস্পষ্ট সুসংবদ্ধ ও স্বতন্ত্র রূপ দান করেছেন। সামাজিক স্তরবিন্যাস সংক্রান্ত আলোচনায় ম্যাক্স ওয়েবার শ্রেণি মর্যাদা ও দলের এক জটিল সমন্বয় উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, একটি শ্রেণি বা মর্যাদার উপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন দল গঠিত হওয়ার আশঙ্কা কম, বরং কোন একটা দলে ভিন্ন শ্রেণি বা গোষ্ঠীর লোক বেশি থাকবে। তাই অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও ওয়েবারের সামাজিক স্তরবিন্যাস তত্ত্বের গ্রহণ যোগ্যতা সবৰ্জনস্বীকৃত।