অথবা, সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রকারভেদসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধরনসমূহের ব্যাখ্যামূলক আলোচনা লিপিবদ্ধ কর।
অথবা, সামাজিক স্তরবিন্যাস কত প্রকার হতে পারে? এ প্রসঙ্গে তোমার মতামত দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : Social Stratification প্রত্যয়টি একটি সমাজতান্ত্রিক প্রত্যয়। ভূতত্ত্বে Strata প্রত্যয়টি মাটি বা শিলার বিভিন্ন স্তর (Strata) বুঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ভূতত্ত্বের এ প্রত্যয়টি সমাজের উঁচুনিচু বিভিন্ন শ্রেণি বা মর্যাদার মানুষকে বুঝাতে সমাজবিজ্ঞানে সন্নিবেশিত হয়েছে। স্তর প্রত্যয়টিকে সিঁড়ি বা মইয়ের ধাপের সাথে তুলনা করা যায়। যেভাবে স্তরগুলো সজ্জিত বা বিন্যস্ত করা হয় তাই স্তরবিন্যাস
স্তরবিন্যাসের প্রকরণসমূহ : টি. বি. বটোমোর (T.B. Bottomore) তাঁর ‘Sociology’ গ্রন্থে বলেছেন, সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক স্তরবিন্যাসের চারটি রূপ বা প্রকরণের কথা বলেছেন। যথা :
১. দাসপ্রথা (Slavery);
২. জাতিবর্ণ প্রথা (Caste);
৩. এস্টেট (Estate);
৪. শ্রেণি এবং মর্যাদা গোষ্ঠী (Class and status group)
১. দাসপ্রথা (Slavery) : দাসপ্রথা Social stratification এর প্রাচীনতম রূপ। অসম সামাজিক সম্পর্কের চরম দৃষ্টান্ত Slavery। পৃথিবীর সর্বত্র প্রাচীন সভ্যত৷ Slavery এর উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন সময়ে দাসপ্রথা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখা যায়। তবে দাসপ্রথার দুটি প্রধান উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়। যথা:
প্রথমত, প্রাচীন সমাজ বিশেষ করে প্রাচীন গ্রিস ও রোমান সমাজের দাস ব্যবস্থা।
দ্বিতীয়ত, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার দক্ষিণাংশের রাজ্যসমূহে তৃতীয় পদ পর্যন্ত এ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
উপর্যুক্ত দু’প্রকার দাসত্ব প্রথা অর্থনৈতিক স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত হয়। দাসপ্রথার বিকাশের সাথে এক ধরনের অভিজাত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, যারা দাসের শ্রমের উপর নির্ভরশীল। Max Weber দাসপ্রথাকে Industrial system হিসেবে গণ্য করেছেন।
২. জাতিবর্ণপ্রথা (Caste) : আদিকাল থেকে জাতিভেদ প্রথা ভারত বাংলাদেশে প্রচলিত রয়েছে। দীর্ঘকাল যাবৎ এ প্রথা প্রচলিত থাকায় সমাজব্যবস্থায় এর ভিত্তি সুদৃঢ় হয়ে যায়। সামাজিক স্তরবিন্যাসের অন্যতম প্রকরণ হলো জাতিবর্ণপ্রথা। Caste বা জাতিবর্ণপ্রথা ভারতীয় সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে এক বিশেষ রূপ পেয়েছে। Caste শব্দটি স্পেনীয় Cesta হতে এসেছে; যার অর্থ প্রজনন বা বংশগত ধারা। সাধারণত ভারতীয় কিছু সমাজকে জাতিবর্ণভিত্তিক সমাজ বলে অভিহিত করা হয়। ভারতীয় জাতিবর্ণপ্রথা সামাজিক স্তরবিন্যাস ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে অদ্বিতীয়।
International Encyclopedia of the Social Science এ বলা হয়েছে, “A caste system then can be social to occur when a society is composed of birth ascribe hierarchically ordered and culturally ethnic group.” জাতিবর্ণ ব্যবস্থা ধর্মীয়, অপবিত্র এবং পবিত্র ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা হিন্দুধর্ম কর্তৃক অনুমোদিত বা স্বীকৃত। প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক রিজলি ভারতবর্ষে ৩৬০টি Caste এর কথা উল্লেখ করেছেন। প্রত্যেকটি আবার কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিতে বিভক্ত। হিন্দুধর্ম অনুযায়ী ৪টি বর্ণ হলো :
i. ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত শ্রেণি : জাতিবর্ণপ্রথার সবচেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী। ব্রাহ্মণদের কাজ ধর্মকর্ম করা।
ii. ক্ষত্রিয় বা যোদ্ধা শ্রেণি : এদের কাজ যুদ্ধবিগ্রহ করা। ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণদের চেয়ে কম মর্যাদার অধিকারী।
iii. বৈশ্য : এদের কাজ ব্যবসায় বাণিজ্য। এরা ক্ষত্রিয়দের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদার অধিকারী।
iv. শূদ্র বা শ্রমজীবী শ্রেণি : এদের কাজ ছিল কায়িক পরিশ্রম। এদের মর্যাদা বৈশ্যদের চেয়ে কম।
৩. এস্টেট (Estate) : মধ্যযুগের ইউরোপীয় সামন্ত সমাজের স্তরবিন্যাস এস্টেট প্রথার মধ্যেই বিস্তৃত ছিল। Estate বলতে কখনো ভূসম্পত্তি বা খামার, কখনো সামাজিক শ্রেণি, কখনো বা অধিকার বা কর্তব্য বুঝায়। উল্লেখ্য Estate প্রত্যয়টি ফরাসি বিপ্লব পূর্ব ও পরবর্তী সামাজিক স্তরকে
বুঝাতে ব্যবহৃত হতো।
উদ্ভব ও বিকাশ : Estate এর উদ্ভব ঘটে মধ্যযুগে তথা অষ্টম ও নবম শতাব্দী হতে এবং এর চরম বিকাশ সাধিত হয় ১৪৪৩ সালের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত
শ্রেণিবিভাগ : মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থা তিনটি Estate এ বিভক্ত ছিল। যথা ঃ
১. প্রথম এস্টেটে : পুরোহিত শ্রেণি (The clergy);
২. দ্বিতীয় এস্টেটে : অভিজাত শ্রেণি (The Nobility);
৩. তৃতীয় এস্টেটে : সাধারণ শ্রেণি (The commoners)।
৪. শ্রেণি এবং মর্যাদা গোষ্ঠী (Class and status group): আধুনিক সমাজে সামাজিক স্তরবিন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপ হলো সামাজিক শ্রেণি ও পদমর্যাদা। মূলত সামাজিক পদমর্যাদার আলোকেই সামাজিক শ্রেণি নির্ধারিত হয়ে থাকে। সামাজিক শ্রেণিসমূহ হচ্ছে এক একটি বাস্তব গোষ্ঠী যাদের আইনগত ও ধর্মীয়ভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। কার্ল মার্কস (Karl Marx) সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে অর্থনৈতিক ভিত্তিতে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘Das Capital’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, “Classes are based on the basis of ownership and non-ownership of means of production. Classes occupy different positions in the organization of production classes are in the struggle.” Marx শ্রেণিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: Class in itself ও ii. Class for itself.
অন্যদিকে, মর্যাদা গোষ্ঠীর মূলভিত্তি হলো Social honour। সমাজ যেভাবে Social honour কে বিভাজন করে তারই ভিত্তিতে সমাজে মর্যাদা গোষ্ঠী গড়ে উঠে। জীবনযাত্রার মান এ ধরনের সম্মান বিভাজনের নির্দেশক।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, ‘Social Stratification’ বলতে উৎকৃষ্টতা ও নিকৃষ্টতার ভিত্তিতে ক্রমোচ্চভাবে সমাজের বিভাজনের প্রক্রিয়াকে বুঝায়। অন্যকথায় সমাজকে বিভিন্ন স্তরে ক্রমোচ্চভাবে বিভাজনই সামাজিক স্তরবিন্যাস। একটি সমাজকে সম্পত্তির মালিকানা, অমালিকানা, মর্যাদা ও ক্ষমতার অসম বণ্টনের ভিত্তিতে ক্রমোচ্চভাবে একাধিক স্তরে ভাগ করা হয়ে থাকে।