সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্রিয়াবাদি তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, কিংসলে ডেভিস এবং উইলবার্ট ম্যূর এর সামাজিক স্তরবিন্যাসে ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে যা জান লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
স্তরবিন্যাসবিহীন সমাজব্যবস্থা শুধুই কল্পনা, রাস্তবে পাওয়া সম্ভব নয়। স্তরবিন্যাসের কারণ নিয়ে অনেক সমাজবিজ্ঞানীই আলোচনা করেছেন। এত্ত্বের উল্লেখযোগ্য প্রবক্তারা হলেন ডুর্খেইম, কিংসলে ডেভিস, ট্যালকট পারসনস্, মার্টন এবং উইলবার্ট ম্যুর। এখানে স্তরবিন্যাসের ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো :
ক্রিয়াবাদী তত্ত্বের মূলবক্তব্য : স্তরবিন্যাসের ব্যাখ্যায় মার্কস বৈষম্যের উপর জোর দিলেও তিনি স্তরবিন্যাসকে দরকারি বা প্রয়োজনীয় কোন ব্যবস্থা মনে করেন নি। অনেক সমাজবিজ্ঞানীই মার্কসের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। এ প্রেক্ষিতে ক্রিয়াবাদীদের উদ্ভব এবং স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তারা স্তরবিন্যাসের অবশ্যম্ভাব্যতা এবং প্রয়োজনীয়তার পক্ষে যুক্তি প্রদান করেছেন। ১৯৪৫ সালে কিংসলে ডেভিস (Kingsley Devis) এবং উইলবার্ট ম্যুর (Willbert Moore) সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, মানবজীবন কর্মবহুল। সমাজে জীবনযাপনের জন্য মানুষকে বিভিন্ন কাজ করতে হয়। প্রতিটি সমাজ কাঠামোয় প্রতিটি ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো সচেতনভাবেই কার্যসম্পাদনের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তিদের দ্বারা পূরণ করার
নিশ্চয়তা দিতে হয়। শুধু তাই নয়, যারা দায়িত্ব পেল তারা যেন সুষ্ঠুভাবে কার্যসম্পাদনের সুযোগ পায় সেই নিশ্চয়তাও সমাজকে দিতে হয়। সুতরাং প্রাকৃতিকভাবেই কাজের গুরুত্বের উপর নির্ভর করে যোগ্যতম ব্যক্তিদের মাঝে বণ্টনের উপর নির্ভর করে সমাজে স্তরবিন্যাসের সৃষ্টি হয়। সুতরাং স্তরবিন্যাসের উপস্থিতি সমাজ কাঠামোতে আবশ্যক। যুক্তিসংগত ভাবেই সমাজ কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো সবচেয়ে দক্ষতাসম্পন্ন লোকেরা স্থান পাবে, যাদের জন্য অধিকতর সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে। ডেভিস এবং ম্যূর বলেন, এসব যোগ্যতম দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা সমাজের উঁচু স্তরের। তারা অধিক সামাজিক সুযোগ সুবিধা, খ্যাতি, মর্যাদা, বেশি বেতন ভোগ করার অধিকার রাখে। ডেডিস এবং ম্যুর স্তরবিন্যাসকে বাজার ব্যবস্থার সাথে তুলনা করেছেন। বাজারে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি কিন্তু যোগান কম, সেসব পণ্যের দাম যেমন বেশি হয় ঠিক তেমনি সমাজেও অধিক দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের পরিমাণ কম থাকায় তাদের জন্য অধিক বেতন, মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা রাখতে হয়। এগুলো ব্যক্তিকে ঐসব কাজের প্রতি আকৃষ্ট করে। সমাজের কল্যাণে তাই স্বাভাবিকভাবেই এ স্তরবিন্যাসকে মেনে নিতে হয়। তাঁদের মতে, সামাজিক স্তরবিন্যাসে এ অসমতা সমাজের স্বার্থে অসচেতনভাবেই তৈরি হয়। সমাজের বৈচিত্র্যময় কাজের জন্য ভিন্ন মেধা ও গুণাবলি সম্পন্ন লোকের প্রয়োজন হয়। সুতরাং খুব স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন কাজের জন্য ভিন্ন মেধার লোক এসে যোগদান করবে। অতএব স্তরবিন্যাস অবশ্যম্ভাবী ও প্রয়োজনীয় একটা বৈশিষ্ট্য যা সমাজে জন্ম নেবে। ডেভিস এবং ম্যুর স্তরবিন্যাস বলতে মূলত সম্পদ ও খ্যাতির অসম বণ্টনকে বুঝিয়েছেন। তাঁদের মতে, কোন সমাজই শ্রেণিহীন নয়। সব সমাজেই স্তরবিন্যাস দেখা যায়, যা সমাজের একটা সর্বজনীন চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। সুতরাং উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, এ তত্ত্বে সামাজিক স্তরবিন্যাস উদ্ভবের কারণকে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সর্বজন স্বীকৃত গুরুত্ব থাকলেও এ তত্ত্ব সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।
সমালোচনা : কিংসলে ডেভিস ও উইলবার্ট ম্যুর-এর ক্রিয়াবাদী তত্ত্বটি যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে সমালোচনার দিকগুলো আলোচনা করা হলো :
১.এ তত্ত্বে বলা হয়েছে, স্তরবিন্যাস সর্বজনীন। প্রতিটি সমাজেই সমমর্যাদার একটি সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা আছে, যার অস্তিত্বকে তাহলে অস্বীকার করতে হবে।
2.এ তত্ত্বটি শুধুমাত্র ব্যক্তির পদমর্যাদার প্রেক্ষিতে বিবেচনা করা হয়েছে। এটি মর্যাদা অনুযায়ী সৃষ্ট গোষ্ঠী বা শ্রেণির মতো সামাজিক গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করে না।
৩.এ তত্ত্বটি সামাজিক স্তরবিন্যাস সৃষ্টি বা উৎপত্তি নির্দেশ করে না বরং স্তরবিন্যাসের অস্তিত্বকেই ব্যাখ্যা করে।
8.এ তত্ত্বে সামাজিক স্তরবিন্যাস ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং সংরক্ষণের উপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সামাজিক স্ত রবিন্যাস এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কোন মন্তব্য এখানে করা হয় নি।
৫. সমাজে বয়স, লিঙ্গ, জাতিবর্ণ ইত্যাদি ভিত্তিক যে স্তরায়ন আছে সে সম্পর্কে কিছু বলা হয় নি।
৬. এ তত্ত্বে ডেভিস এবং ম্যুর বলেন যে, যোগ্যতম লোককে গুরুত্বপূর্ণ কাজে আকৃষ্ট করতে হবে। কিন্তু ভারতীয় জাতিবর্ণভিত্তিক সমাজে জন্মগতভাবে পেশা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এখানে সুযোগ সুবিধার বদলে আকৃষ্ট করার কোন ব্যাপার থাকে না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সমাজে ভিন্ন রকম কাজ সম্পাদনের জন্য ভিন্ন মর্যাদার পেশার সৃষ্টি হয়। কিন্তু সব কাজের গুরুত্ব সমান নয়। সুতরাং অধিক পারিশ্রমিকের দ্বারা এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য অধিক দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে নিয়োগ করতে হয়, নতুবা সমাজব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই সামাজিক স্তরবিন্যাস গড়ে উঠে। ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিকদের মতে শ্রেণিহীন বা স্তরবিন্যাসবিহীন সমাজ সম্ভব নয়। সাম্য প্রতিষ্ঠা চেষ্টার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং তাই সমাজে স্তরবিন্যাস বাস্তব একটি সত্য। তাই ক্রিয়াবাদীরা জোর দিয়ে বলেন, স্তরবিন্যাস বাস্তব, অনিবার্য এবং চিরন্তন সত্য।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b7%e0%a6%b7%e0%a7%8d%e0%a6%a0-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4/