অথবা, সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশে যুবকদের সামাজিক সমস্যাসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক সমস্যা কাকে বলে। বাংলাদেশে যুব সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যাগুলো বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক সমস্যা ধারণাটি ব্যাখ্যা কর। বাংলাদেশের যুবকরা কী কী সামাজিক সমস্যা দ্বারা আক্রান্ত আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। আর উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সামাজিক সমস্যা।বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে নানারকম সামাজিক সমস্যা বিদ্যমান। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যুবক। যুবশক্তি হচ্ছে একটি দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের যুবসমাজ নানারকম সামাজিক সমস্যায় পতিত। ফলে দেশের উন্নয়নে তারা অংশীদার হতে পারছে না। কিন্তু যুবশক্তির সমস্যা সমাধান ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই যুব সংক্রান্ত সমস্যা নির্ণয় করে তার সমাধান একান্ত জরুরি।
সামাজিক সমস্যা : সাধারণভাবে সামাজিক সমস্যা বলতে আমরা বুঝি এমন একটি সামাজিক অনভিপ্রেত অবস্থা, যা সমাজের অধিকাংশ লোকের জন্য অনিষ্টকর এবং তাদের অভাব পূরণ ও সামাজিক ভূমিকা পালনের পথে অন্তরায়স্বরূপ।শাব্দিক অর্থে, ইংরেজি ‘Problem’ শব্দের বাংলা পরিভাষা হল সমস্যা। আর ‘Problem’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘Problema’ হতে, যার অর্থ চ্ছে সমাজ কর্তৃক নিক্ষেপিত এমন একটি ঘটনা, যা সমাজস্থ মানুষের চিন্তাভাবনা বা মনোযোগ আকর্ষণের উপর অবাঞ্ছিত চাপ সৃষ্টি করে। অর্থাৎ মানুষ যখন কোন নিক্ষেপিত ঘটনা দ্বারা বাধার সম্মুখীন হয়, তখন তা সমস্যারূপে পরিগণিত হয়। সমস্যার সাথে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং প্রচলিত সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সম্পর্কিত থাকায় ‘সামাজিক’ শব্দ দ্বারা সমস্যাকে বিশেষায়িত করা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন মনীষীগণ সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নি েকয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হল :
মনীষী সি. এম. কেস এর মতে, “সামাজিক সমস্যা হল এমন একটি অবস্থা, যা সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সচেতন ও যোগ্য পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সে অবস্থা সম্পর্কে যৌথ কার্যক্রম গ্রহণের আবেদন ও অনুভূতি সৃষ্টি হয়।”
P. B. Horton & J. R. Leslie তাঁদের ‘Sociology of Social Problems’ গ্রন্থে বলেছেন, “সামাজিক সমস্যা হল সমাজ জীবনের এমন একটি অস্বাভাবিক অবস্থা, যা সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে এবং যার সম্পর্কে যৌথ সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে কিছু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।”
Dryden বলেছেন, “সামাজিক সমস্যা হল এমন এক অবস্থা, যা চাপ, উত্তেজনা, নৈরাজ্য ও বিরোধ সৃষ্টি অভাবমোচনে বাধা দান করে।”
সামাজিক সমস্যার ব্যাপক এবং নির্দিষ্টস্বরূপ নির্ধারণ করে ডেভিড ড্রেসলার বলেছেন, “সামাজিক সমস্যা হল।মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্ট এমন একটি অবস্থা, যাকে সমাজের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোক অস্বাভাবিক বা অবাঞ্ছিত বলে বিবেচনা করে এবং প্রতিকার বা প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে দূরীকরণে তারা বিশ্বাসী হয়।”
সুতরাং বিভিন্ন সংজ্ঞা বিশ্লেষণের আলোকে আমরা বলতে পারি যে, সামাজিক সমস্যা হল সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় হতে উদ্ভূত এমন এক অপ্রীতিকর অবস্থা, যা অধিকাংশ জনসংখ্যাকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে সমাজ ও জনগণের মধ্যে হতাশা, নৈরাজ্য, উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং যার প্রতি জনগণের একটা নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠে। যেমন— আমাদের দেশের বিশেষ বিশেষ সামাজিক সমস্যা হল যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন, কিশোর অপরাধ, জনসংখ্যাধিক্য, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি।
বাংলাদেশে যুবকদের সামাজিক সমস্যা : বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনশক্তি যুবক। কিন্তু বাংলাদেশের যুবসমাজ মারাত্মক সামাজিক সমস্যায় পতিত। নি েবাংলাদেশের যুবসমাজের সামাজিক সমস্যা আলোচনা করা হল :
১. কর্মসংস্থানের অভাব : কর্মসংস্থানের অভাব বাংলাদেশের যুবসমাজের প্রধান সমস্যা। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষিত বেকার রয়েছে। তারা বেকার থাকতে চায় না। কিন্তু কর্মসংস্থানের অভাব তাদের বেকার বানিয়ে রেখেছে। বর্তমানে কর্মসংস্থানের অভাব প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে।
২. বেকারত্ব : বেকারত্ব বাংলাদেশের যুবকদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। দেশে বর্তমানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৩০ লাখ। এছাড়া অর্ধ বেকার, মৌসুমী বেকার ইত্যাদি রয়েছে। দেশে কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বেকারত্বও বেড়ে চলেছে। এছাড়া কৃষি জমি হ্রাস, জমির খণ্ড বিখণ্ডতা ইত্যাদি কারণে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।
৩. কারিগরি জ্ঞানের অভাব : কারিগরি জ্ঞানের অভাব বাংলাদেশের যুবকদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। এদেশে কারিগরি শিক্ষার অভাব রয়েছে। ফলে আমাদের দেশের যুবকরা দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। তাছাড়া প্রযুক্তি জ্ঞান ও শিক্ষার অভাব দেশের যুবসমাজকে বেকার বানিয়ে রাখছে।
৪. মাদকাসক্তি : বাংলাদেশের যুবসমাজের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হল মাদকাসক্তি। এদেশের যুবকরা শিক্ষিত হয়ে কোন কাজ পায় না। ফলে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে অবহেলার শিকার হয়। ফলে তারা হতাশ হয়ে পড়ে। এ হতাশা দূরীকরণের জন্য যুবকরা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতাও নেশায় আসক্ত হওয়ার কারণ। মাদকাসক্তির কারণে তারা সর্বনাশা জীবনে প্রবেশ করে।
৫. স্বাস্থ্যহীনতা : বাংলাদেশের যুবকদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হল স্বাস্থ্যহীনতা। দরিদ্রতা, বেকারত্ব ও অন্যান্য কারণে যুবকরা স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে। তাছাড়া চিকিৎসা ও ঔষধের অভাবেও তারা স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে। স্বাস্থ্যহীনতা যুবকদের নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
পুষ্টিহীনতা : পুষ্টিহীনতা বাংলাদেশের যুবসমাজের অন্যতম সমস্যা। বেকারত্ব, দরিদ্রতা ইত্যাদি কারণে যুবকরা ঠিকমতো খেতে পারে না। তাছাড়া পুষ্টি জ্ঞানের অভাবও তাদের পুষ্টিহীনতার অন্যতম কারণ।
৭. যুব অসন্তোষ : বাংলাদেশের যুবকদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হল যুব অসন্তোষ। বাংলাদেশের যুবকরা নানা কারণে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। ফলে তারা তাদের বঞ্চনার কারণে মাঝে মাঝে অসন্তোষ প্রকাশ করে। তারা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, গাড়ি ভাংচুর ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করে থাকে।
৮. রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি : বাংলাদেশের যুবকদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হল রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করা। সাধারণত রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য যুবসমাজকে ব্যবহার করে। বেকার যুবকরাও সামান্য স্বার্থের কারণে রাজনৈতিক নেতাদের কথামতো চলে। ফলে দলাদলি, বিশৃঙ্খলা, মারামারি ইত্যাদি কাজে তার অংশগ্রহণ করে।
৯. মূল্যবোধের অবক্ষয় : বাংলাদেশের যুবসমাজের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হল মূল্যবোধের অবক্ষয়। মূল্যবোধে অবক্ষয়ের কারণে যুবসমাজ শিক্ষক, বাবা, মা ও মুরুব্বীদের অশ্রদ্ধা করে। তাছাড়া তারা নানা রকমের অনৈতিক কাজকর্ম করে থাকে।
১০. অনুকরণীয় আদর্শের অভাব : বাংলাদেশের যুবসমাজের অন্যতম সমস্যা হল তাদের মাঝে অনুকরণীয় আদর্শের অভাব। এমন কোন আদর্শিক ব্যক্তিত্ব তাদের সামনে উপস্থিত হয় নি যার আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে তারা নিজেদের জীবন গড়ে তুলবে। ফলে তারা দিন দিন আদর্শহীন হয়ে পড়ছে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ, বিধায় এদেশে সামাজিক সমস্যা থাকবে। তবে একথাও মনে রাখতে হবে যে, যুবসমাজ হচ্ছে যে কোন দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি।তাই কোন দেশের উন্নয়নে যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করতেই হবে। তাই বাংলাদেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য যুবসমাজের
সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে তা জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে।