অথবা, সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা দাও। প্রবীণদের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক সমস্যা বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশে প্রবীণদের সমস্যাগুলো কী কী তা বিস্তারিত বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক সমস্যার ধারণা দাও। বাংলাদেশের প্রবীণেরা যে সকল সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয় তা বর্ণনা দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশি। এদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ প্রবীণ। অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মত বাংলাদেশে প্রবীণ সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যাও অত্যন্ত প্রকট। দীর্ঘ কর্মময় জীবন শেষে যখন একজন ব্যক্তি জীবনের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেন তখন তিনি নানা সমস্যায় ভোগেন। অথচ আমরা তাদের দিকে নজর দেই না। কিন্তু আমরা যে সমাজে বাস করি সে সমাজ গঠনে এদের অশেষ অবদান রয়েছে। তাই সমাজের সার্বিক মঙ্গলের জন্য প্রবীণদের সমস্যা সমাধান করা জরুরি।
সামাজিক সমস্যা : সাধারণভাবে সামাজিক সমস্যা বলতে আমরা বুঝি এমন একটি সামাজিক অনভিপ্রেত অবস্থা, যা সমাজের অধিকাংশ লোকের জন্য অনিষ্টকর এবং তাদের অভাব পূরণ ও সামাজিক ভূমিকা পালনের পথে অন্তরায়স্বরূপ।
শাব্দিক অর্থে, ইংরেজি ‘Problem’ শব্দের বাংলা পরিভাষা হল সমস্যা। আর ‘Problem’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘Problema’ হতে, যার অর্থ হচ্ছে সমাজ কর্তৃক নিক্ষেপিত এমন একটি ঘটনা, যা সমাজস্থ মানুষের চিন্তাভাবনা বা মনোযোগ আকর্ষণের উপর অবাঞ্ছিত চাপ সৃষ্টি করে। অর্থাৎ মানুষ যখন কোন নিক্ষেপিত ঘটনা দ্বারা বাধার সম্মুখীন হয়,
তখন তা সমস্যারূপে পরিগণিত হয়। সমস্যার সাথে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং প্রচলিত সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সম্পর্কিত থাকায় ‘সামাজিক’ শব্দ দ্বারা সমস্যাকে বিশেষায়িত করা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন মনীষীগণ সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নি েকয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হল :
মনীষী সি. এম. কেস এর মতে, “সামাজিক সমস্যা হল এমন একটি অবস্থা, যা সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সচেতন ও যোগ্য পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সে অবস্থা সম্পর্কে যৌথ কার্যক্রম গ্রহণের আবেদন ও অনুভূতি সৃষ্টি হয়।”
P. B. Horton & J. R. Leslie তাঁদের ‘Sociology of Social Problems’ গ্রন্থে বলেছেন, “সামাজিক সমস্যা হল সমাজ জীবনের এমন একটি অস্বাভাবিক অবস্থা, যা সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে এবং যার সম্পর্কে যৌথ সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে কিছু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।”
Dryden বলেছেন, “সামাজিক সমস্যা হল এমন এক অবস্থা, যা চাপ, উত্তেজনা, নৈরাজ্য ও বিরোধ সৃষ্টি করে এবং অভাবমোচনে বাধা দান করে।”
সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী, “সামাজিক সমস্যা হল জনগণের মধ্যে বিদ্যমান এমন অবস্থা, যা কিছু লোকের আদর্শ ও মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং আবেগীয় অথবা আর্থিক ক্ষতির কারণরূপে দেখা দেয়। সামাজিক সমস্যার উদাহরণের অন্তর্ভুক্ত হল অপরাধ, সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, বর্ণবাদ, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার সীমিত সম্পদের অসম বণ্টন।”
সুতরাং বিভিন্ন সংজ্ঞা বিশ্লেষণের আলোকে আমরা বলতে পারি যে, সামাজিক সমস্যা হল সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় হতে উদ্ভূত এমন এক অপ্রীতিকর অবস্থা, যা অধিকাংশ জনসংখ্যাকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে সমাজ ও জনগণের মধ্যে হতাশা, নৈরাজ্য, উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং যার প্রতি জনগণের একটা নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠে। যেমন- আমাদের দেশের বিশেষ বিশেষ সামাজিক সমস্যা হল যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন, কিশোর অপরাধ, জনসংখ্যাধিক্য, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি।
বাংলাদেশে প্রবীণদের সমস্যা : বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৬৩ বছর। তাই ৬০ বছরের ঊর্ধ্বের লোকদেরকেই প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ধরনের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬.১%। নি েপ্রবীণদের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যা আলোচনা করা হল :
১. কর্মসংস্থানের অভাব : বাংলাদেশে প্রবীণদের প্রধান সামাজিক সমস্যা হল কর্মসংস্থানের অভাব।অভাবে তাদের আয় বঞ্চিত। ফলে পারিবারিকভাবে তারা অবহেলার শিকার হন। যারা চাকরিজীবী তারা ৬০ বছরের আগেই অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর পেনশনের টাকা পান খুব কম। তাছাড়া যারা চাকরি করেন না, দরিদ্র অসচ্ছল তাদের অবস্থা আরও করুণ। এ ধরনের প্রবীণরা পারিবারিকভাবে মারাত্মক অবহেলার শিকার। অনেক প্রবীণ আছেন যারা ঠিকমতো খেতে পারেন না। ফলে বাধ্য হয়ে তারা ভিক্ষাবৃত্তিকে গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে সরকারিভাবে এসব প্রবীণদের জন্য কোন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। ফলে এদেশে প্রবীণদের দেখার মত কেউ নেই।
২. স্বাস্থ্যহীনতা : বাংলাদেশে প্রবীণদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা স্বাস্থ্যহীনতা। এদেশের অধিকাংশ লোক ৪০ বছরের পর নানারকম স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগে থাকেন। এ সময় ডায়াবেটিকস, হার্টের সমস্যা, চোখের সমস্যা ইত্যাদি মারাত্মক আকার ধারণ করে। অর্থাভাবে তাঁরা ঠিকমতো চিকিৎসা নিতে পারেন না।
৩. পুষ্টিহীনতা : পুষ্টিহীনতা প্রবীণদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। প্রবীণ বয়সে স্বাভাবিক খাবার তারা খেতে পারেন না। তাদের জন্য পুষ্টিকর ও বিশেষ খাবারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অর্থের অভাবে তারা তার সংস্থান করতে পারে না।
৪. পারিবারিক অবহেলা : যে মানুষ সারাজীবন কঠোর পরিশ্রম করে পরিবারের ভরণপোষণ করে, সে যখন বৃদ্ধ হয় তখন পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এসব প্রবীণদের সাথে পরিবারের সদস্যরা খারাপ ব্যবহার করে। রোগ হলে ঠিকমতো সেবা করে না। অনেকে প্রবীণদের মারধরও করে থাকে।
৫. সামাজিক অবহেলা : প্রবীণদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হল সামাজিক অবহেলা। পারিবারিকভাবে প্রবীণরা যেমন অবহেলার শিকার হন তেমনি সামাজিকভাবেও এদের ছোট করে দেখা হয়। সামাজিক অবহেলার কারণে প্রবীণরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
৬. রাষ্ট্রীয় অবহেলা : বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৬.১ ভাগ প্রবীণ। এসব প্রবীণরা নানারকম সামাজিক সমস্যার শিকার। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রবীণদের সামাজিক সমস্যা মোকাবিলার জন্য কোন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি।বর্তমানে বৃদ্ধভাতা ও বিধবা ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তবে তার পরিমাণ ও সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
৭. বিনোদনের অভাব : বিনোদনের অভাব বাংলাদেশে প্রবীণদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য বিনোদনের কোন ব্যবস্থা নেই। শহর এলাকায় দু’একটি পার্ক থাকলেও তা প্রবীণদের যাওয়ার অনুপযোগী। তাছাড়া রেডিও টেলিভিশনে প্রবীণদের উপযোগী কোন অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় না। এছাড়াও পারিবারিক বিনোদনে প্রবীণদের অংশগ্রহণের সুযোগ কম।
৯. নিঃসঙ্গতা : নিঃসঙ্গতা প্রবীণদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশে বর্তমানে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ে উঠেছে। ফলে প্রবীণ ব্যক্তিরা ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনীদের সাহচর্য লাভ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এছাড়া
প্রবীণদের কেউই সময় দিতে চায় না। কোন কোন প্রবীণ ছেলেমেয়েদের বছরে একবারও দেখার সুযোগ পায় না। ফলে প্রিয়জনদের বিরহে তারা নিঃসঙ্গতায় ভুগে থাকেন।
৯. মৃত্যু ভয় : মৃত্যু ভয় বাংলাদেশে প্রবীণদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। বৃদ্ধ বয়সে স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। ফলে প্রবীণরা সব সময় মৃত্যু ভয়ে ভীত থাকে। যা তাদের আরও আতঙ্কিত ও হতাশ করে তোলে। তাছাড়া এ পৃথিবীর মায়া কেউই সহজে ছাড়তে চায় না। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ভাবনা তাদের অস্থির করে তোলে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রবীণ হওয়া সত্ত্বেও প্রবীণদের কল্যাণের দিকটি সমাজে অনুপস্থিত। ফলে প্রবীণরা নানারকম সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যার শিকার হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আমাদেরও উক্ত অবস্থায় পতিত হতে হবে। তাই প্রবীণদের এ সমস্যার আশু সমাধান হওয়া একান্ত জরুরি।