সামাজিক সমস্যা কাকে বলে? বাংলাদেশে শিশু সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যাগুলো আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের শিশু সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যার বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক সমস্যা বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশে বিদ্যমান শিশু সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যাগুলো আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশের শিশু সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যা বিস্তারিত বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সেদেশে সামাজিক করে সমস্যা বিদ্যমান। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে সামাজিক সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। ফলে এসব সামাজিক সমস্যা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন কোটি শিশু রয়েছে। শিশুরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে প্রায় ১০% শিশুশ্রমের সাথে জড়িত। ফলে তাদের স্বাস্থ্য ও মনের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এর কারণে সমাজে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও দেশে নানারকম শিশু সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা অচিরেই দুর করতে না পারলে দেশ এক ভয়াবহ সংকটে পড়বে। নি েসামাজিক সমস্যা সম্পর্কে
বিস্তারিত আলোচনা করা হল :
সামাজিক সমস্যা : সাধারণভাবে সামাজিক সমস্যা বলতে আমরা বুঝি এমন একটি সামাজিক অনভিপ্রেত অবস্থা, যা সমাজের অধিকাংশ লোকের জন্য অনিষ্টকর এবং তাদের অভাব পূরণ ও সামাজিক ভূমিকা পালনের পথে অন্তরায়স্বরূপ।
শাব্দিক অর্থে, ইংরেজি ‘Problem’ শব্দের বাংলা পরিভাষা হল সমস্যা। আর ‘Problem’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘Problema’ হতে, যার অর্থ হচ্ছে সমাজ কর্তৃক নিক্ষেপিত এমন একটি ঘটনা, যা সমাজস্থ মানুষের চিন্তাভাবনা বা মনোযোগ আকর্ষণের উপর অবাঞ্ছিত চাপ সৃষ্টি করে। অর্থাৎ মানুষ যখন কোন নিক্ষেপিত ঘটনা দ্বারা বাধার সম্মুখীন হয়, তখন তা সমস্যারূপে পরিগণিত হয়। সমস্যার সাথে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং প্রচলিত সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সম্পর্কিত থাকায় ‘সামাজিক’ শব্দ দ্বারা সমস্যাকে বিশেষায়িত করা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন মনীষীগণ সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হল :
মনীষী সি. এম. কেস এর মতে, “সামাজিক সমস্যা হল এমন একটি অবস্থা, যা সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সচেতন ও যোগ্য পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সে অবস্থা সম্পর্কে যৌথ কার্যক্রম গ্রহণের আবেদন ও অনুভূতি সৃষ্টি হয়।”
P. B. Horton & J. R. Leslie তাঁদের ‘Sociology of Social Problems’ গ্রন্থে বলেছেন, “সামাজিক সমস্যা হল সমাজ জীবনের এমন একটি অস্বাভাবিক অবস্থা, যা সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে এবং যার সম্পর্কে যৌথ সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে কিছু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।”
Dryden বলেছেন, “সামাজিক সমস্যা হল এমন এক অবস্থা, যা চাপ, উত্তেজনা, নৈরাজ্য ও বিরোধ সৃষ্টি করে এবং অভাবমোচনে বাধা দান করে।”
Rabb & Selynic বলেছেন, “সামাজিক সমস্যা হচ্ছে মানুষের সম্পর্ক থেকে সৃষ্ট এমন একটি সমস্যা, যা প্রচণ্ডভাবে সমাজকে আঘাত করে বা বহুলোকের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশাকে ব্যাহত করে।”
সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী, “সামাজিক সমস্যা হল জনগণের মধ্যে বিদ্যমান এমন অবস্থা, যা কিছু লোকের আদর্শ ও মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং আবেগীয় অথবা আর্থিক ক্ষতির কারণরূপে দেখা দেয়। সামাজিক সমস্যার উদাহরণের অন্তর্ভুক্ত হল অপরাধ, সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, বর্ণবাদ, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার সীমিত সম্পদের অসম বণ্টন ।”
সুতরাং বিভিন্ন সংজ্ঞা বিশ্লেষণের আলোকে আমরা বলতে পারি যে, সামাজিক সমস্যা হল সমাজের সামাজিক সাংস্কৃতিক অবক্ষয় হতে উদ্ভূত এমন এক অপ্রীতিকর অবস্থা, যা অধিকাংশ জনসংখ্যাকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে সমাজ ও জনগণের মধ্যে হতাশা, নৈরাজ্য, উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং যার প্রতি জনগণের একটা নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠে। যেমন- আমাদের দেশের বিশেষ বিশেষ সামাজিক সমস্যা হল যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন, কিশোর অপরাধ, জনসংখ্যাধিক্য, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি।
বাংলাদেশে শিশু সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যা : শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ আজকে যে শিশু আগামী দিনে সেই দেশকে নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু জীবনের শুরুতেই যদি তারা সমস্যায় পতিত হয় তাহলে তাদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। আমাদের দেশে বর্তমানে এ অবস্থা চলছে। নি েবাংলাদেশে শিশু সংক্রান্ত যেসব সামাজিক সমস্যা রয়েছে তা আলোচনা করা হল :
১. পুষ্টিহীনতা : বাংলাদেশে শিশু সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান হল পুষ্টিহীনতা। WHO এর জরিপে দেখা যায় এদেশের শতকরা ৮০ ভাগ শিশু পুষ্টিহীনতার শিকার। অন্যদিকে, গ্রামে শতকরা ৯০ ভাগ শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে । দরিদ্রতা, অশিক্ষা, পুষ্টিজ্ঞানের অভাব ইত্যাদি কারণে শিশুরা পুষ্টিহীনতার শিকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০০ সালের জরিপ মতে এদেশে পুষ্টিমানসম্পন্ন শিশুর হার ১১.৫%। চরম পুষ্টিহীনতা, মাঝারি পুষ্টিহীনতা ও মৃদু পুষ্টিহীনতার হার যথাক্রমে ২.৪%, ৩৪.৭% ও ৫০.৭%। পুষ্টিহীনতার কারণে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।শিশুরা নানারকম রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংস হচ্ছে।
২. নিরক্ষরতা : বাংলাদেশের শিশুদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হল নিরক্ষরতা। প্রতিবছর এদেশে ২২ লক্ষ শিশু জন্মগ্রহণ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ জন্মে দরিদ্র পরিবারে। দারিদ্রতার কারণে শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। জাতিসংঘের হিসাব মতে ৮৩% শিশু স্কুলে যায়। ঝরে পড়ে ৩%। বাকি শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে। অর্থাৎ নিরক্ষর থাকে। সরকার অবশ্য সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। তবে নানা প্রতিকূলতার কারণে তা সফল হচ্ছে না। জাতিসংঘ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট পোল এ নিরক্ষরতা দূরীকরণের
পদক্ষেপ নিয়েছে।
৩. শিশুশ্রম : শিশুশ্রম বাংলাদেশে শিশুসংক্রান্ত অন্যতম সামাজিক সমস্যা। ILO এর হিসেব মতে, বাংলাদেশের ১০% শিশু শ্রমের সাথে জড়িত। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সাথেও শিশুরা জড়িত। এসব ঝুঁকিপূর্ণ কারণে বিভিন্ন দুর্ঘটনা এমনকি শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। বাংলাদেশের বাসাবাড়ি, কলকারখানা, বিড়ির কারখানা, ওয়ার্কশপ, গার্মেন্টস শিল্পে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে।
৪. শিশুর অপব্যবহার : শিশুর অপব্যবহার বর্তমানে বাংলাদেশে শিশু সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যার মধ্যে অন্যতম।বাংলাদেশে শিশুদের যৌনাচারে বাধ্য করা হয়। শিশুদের ধর্ষণও করা হয়ে থাকে। রাজশাহীর শিশু মিলি ধর্ষণ ও হত্যা এর উদাহরণ। এছাড়া বাসাবাড়িতে কাজের মেয়ের সাথে বিভিন্ন ধরনের অপব্যবহারের কথা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।তাদের সাথে খারাপ আচরণ ও পিতামাতা কর্তৃক অবহেলা করা হয়।
৫. যৌন উৎপীড়ন ও শিশুপাচার : বাংলাদেশে শিশু সংক্রান্ত অন্যতম সামাজিক সমস্যা হল শিশুপাচার ও শিশুদের যৌন উৎপীড়ন। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার শিশু মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পাচার হচ্ছে।মধ্যপ্রাচ্যে পাচারকৃত শিশুরা উটের জকি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝেই এ ধরনের সংবাদ বের হয়।
বাংলাদেশে শিশুপাচারের জন্য সংঘবদ্ধ পাচারকারী দল রয়েছে। মেয়ে শিশুদের ভারতের পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়।এসব শিশুরা পতিতালয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। তাছাড়া বাড়িওয়ালা কর্তৃক গৃহপরিচালিকা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে অহরহ। ঢাকা শহরে শিশুদের মাদকদ্রব্য পাচার ও মাদক ব্যবসায় নিয়োজিত করা হচ্ছে। এছাড়াও শিশুদের দিয়ে অপরাধও সংঘটিত করা হচ্ছে।
৬. প্রতিবন্ধিতা : বাংলাদেশে শিশু সংক্রান্ত অন্যতম সামাজিক সমস্যা হল প্রতিবন্ধিতা।বাংলাদেশে নানাকারণে প্রতিবছর অনেক প্রতিবন্ধী শিশু জন্মগ্রহণ করে।এসব শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বসবাস করতে পারে না। ফলে তারা পারিবারিক ও সামাজিক অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার হয়। এসব প্রতিবন্ধীদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করানো হয়।
৭. লিঙ্গ বৈষম্য : বাংলাদেশে শিশু সংক্রান্ত অন্যতম সামাজিক সমস্যা হল লিঙ্গ বৈষম্য। লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার অবশ্য নারীরা। বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ পরিবারে ছেলে শিশুদের যেভাবে লালনপালন ও আদর যত্ন করা হয় মেয়েদের বেলায় তা করা হয় না। তাছাড়া অনেক পরিবারে মেয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করলে মেয়ে শিশু ও মাকে অবহেলা করা । কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণের সাথে সাথে মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও কন্যাশিশুদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীলদেশে সামাজিক সমস্যা থাকবেই। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এদেশে শিশু সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যাগুলো যেভাবে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে তা যদি থামানো না যায় তাহলে অদুর ভবিষ্যতে দেশ ভয়াবহ সংকটে পড়বে। তবে আশার কথা সরকার শিশু সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যা সমাধানকল্পে কঠোর আইন প্রণয়ন করছে। এর সাথে জনগণকেও সচেতন ও সজাগ হতে হবে। তবেই এ থেকে মুক্তি সম্ভব।