সামাজিক সমস্যার কারণগুলো আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক সমস্যা কেন সৃষ্টি হয়?
অথবা, সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির জন্য কি কি কারণ দায়ী?
অথবা, কী কী কারণে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয় তা বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক সমস্যার কারণসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রতিটি সমাজই সমস্যামুক্ত হতে চায়। কিন্তু সামাজিক সমস্যা সমাধান করতে হলে আগ জানতে হবে সমস্যার উৎস কোথায়। মূলত সমাজ এবং সামাজিক সমস্যা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। অপূর্ণতা হল সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কোন সমাজই এককভাবে পরিপূর্ণ নয়। সমাজবিজ্ঞানে এ অপূর্ণতা সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হয়। সমস্যা না থাকলে সমাজ স্থবির হয়ে পড়ত। সমস্যা আছে বলে মানুষ সমাধান করার প্রচেষ্টা করে। আর এ প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানবসমাজ গতিশীল থাকে।
সামাজিক সমস্যার কারণ : সামাজিক সমস্যার কারণ একাধিক। একক কোন কারণ হতে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয় না। সমাজবিজ্ঞানীদের বিভিন্ন মন্তব্য হতে সামাজিক সমস্যার কারণ সম্পর্কে মৌলিক ধারণা পাওয়া যায় ৷ যেমন- সমাজবিজ্ঞানী Gillin এর মতে, “বিশ্বজগতের সাথে মানুষের এবং মানুষের সাথে সমাজের সমন্বয় সাধনের সমস্যা হতে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা।”
সমাজবিজ্ঞানী Wolf তাঁর ‘Reading to Social Problem’ গ্রন্থে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে সামাজিক সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন ।
সমাজবিজ্ঞানী C. M. Case তাঁর ‘Analysing Social Problem’ গ্রন্থে সামাজিক সমস্যার কারণ হিসেবে যা চিহ্নিত করেন, তা নিম্নে আলোচনা করা হল :
১. প্রতিকূল প্রাকৃতিক অবস্থা,
2. জনসংখ্যার ত্রুটিপূর্ণ প্রকৃতি,
৩. সামাজিক বিন্যাসের অসংগতি ও ত্রুটিপূর্ণতা এবং
৪. বিভিন্ন শ্রেণীর আদর্শ ও মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব ।
তবে সামাজিক সমস্যার একাধিক কারণ থাকা সত্ত্বেও এর মৌলিক কারণ দু’টি। যথা :
১. অসম পরিবর্তনজনিত অসংগতি এবং
2. সমাজস্থ মানুষের মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থতা।
সুতরাং দেখা যায় যে, প্রত্যেক সমাজবিজ্ঞানীই সামাজিক সমস্যার কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক, জৈবিক, সামাজিক,
অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানের যে কোন এক বা একাধিক বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। এসব
কারণগুলোকে সমস্যার প্রকৃতি অনুযায়ী দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। যথা :
১. প্রবণতা সৃষ্টিকারী কারণ ও
2. অব্যবহিত কারণ ।
সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি পর্যালোচনা করে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির পিছনে যে কারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত নিম্নে তা আলোচনা করা হল :
১. মূল্যবোধের অবক্ষয় : সামাজিক সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দায়ী করা যায়।
মূল্যবোধের অভাবহেতু মানুষ কোনটি গ্রহণযোগ্য, কোনটি অগ্রহণযোগ্য, কোনটি সঠিক, কোনটি সঠিক নয়, কোনটি সত্য,
কোনটি মিথ্যা, কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ এ পার্থক্য হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ, মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এরূপ
পরিস্থিতিতে মানুষ যা ইচ্ছা তাই করতে প্রবৃত্ত হয়। মানুষ এভাবে নিজেকে সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে। সমাজের
ব্যক্তিবর্গ মূল্যবোধ শূন্য হয়ে গেলে সমাজে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব ঘটে।
২. সামাজিক পরিবর্তন : সামাজিক সমস্যার কারণ হিসেবে সমাজের পরিবর্তনকে দায়ী করা হয়। সমাজ সরল থেকে
জটিল অবস্থায় পর্যবসিত হয়। সমাজ বিকাশের ধারায় সমাজ ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করে। আধুনিক শিল্পসমাজে মানুষের
নানামুখী চাহিদার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যার উদ্ভব ঘটে।
৩. মানসিক শূন্যতা : আধুনিক শিল্পসমাজে মানুষ নিজেকে সমাজ থেকে, অপরাপর ব্যক্তি থেকে এবং এক পর্যায়ে
নিজেকেই নিজ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে শিখে। অর্থাৎ, মানুষ বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিতে মানসিক নিরাপত্তাহীনতায়
ভোগে এবং এভাবে সমাজে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
৪. মানবিক চাহিদার ঘাটতি : প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে দার্শনিক এরিস্টটল বলেছিলেন, জগতের সকল মানুষ
জন্মগতভাবে সমান। তিনি সকল মানুষের সম্পদ ভোগের সমঅধিকারকে এ কথার মধ্যদিয়ে ইঙ্গিত করেছেন। মানুষ
জন্মগতভাবে সমান হলেও সমাজের সম্পদ ভোগের সমঅধিকার থেকে সে বঞ্চিত। মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ সমাজ
জীবনের অন্যতম মৌলিক আদর্শ। কিন্তু মানুষ তার মানবিক চাহিদা পূরণে অপারগ। যখন সে মানবিক চাহিদা পূরণের
জন্য সমাজের সাম্যনীতির পথে বাধা অতিক্রম করতে যায়, তখনই সামাজিক সমস্যার উদ্ভব ঘটে। সমাজ ব্যক্তিকে
অপরাধবোধ, হীনম্মন্যতায় পর্যবসিত করে তোলে।
৫. সম্পদের অসম কটন : আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সম্পদের অসম বণ্টন। সম্পদের অসম
বণ্টনের ফলশ্রুতিতে সমাজে ধনী-দরিদ্র বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। সমাজে সন্ত্রাস, অপরাধ, দুর্নীতির ন্যায় সামাজিক সমস্যার
জন্য সম্পদের অসম বণ্টন বিষয়টি বিশেষভাবে দায়ী।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সামাজিক সমস্যা মানবজীবনের সার্বিক উন্নয়নে
প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে উন্নত জীবনমান লাভে বাধাগ্রস্ত করে। আর এ সামাজিক সমস্যার উৎসও Multidisciplinary বা
বহুমুখী। মূলত সমাজ সৃষ্টির সূচনালগ্নে সমাজকাঠামো ছিল সহজ। তাই তখন সামাজিক সমস্যা ছিল একমুখী। কালক্রমে
সমাজকাঠামো বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়ে জটিল রূপ নিয়েছে। তাই সামাজিক সমস্যা জটিল ও বহুমুখী রূপ নিয়েছে।