সামাজিক পরিবর্তনের রৈখিক মতবাদ আলোচনা কর।

অথবা, সামাজিক পরিবর্তনের রৈখিক মতবাদটি বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সমাজ সর্বদা পরিবর্তনশীলতার নিয়ম মেনে চলে। কোন সমাজই স্থির বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে থাকে না। বিভিন্ন সমাজে এ পরিবর্তন বিভিন্ন নিয়মে সংঘটিত হয়। আবার একই সমাজে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট সামাজিক পরিবর্তন ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল প্রদান করতে পারে। সমাজের উন্নতি, অবনতি অনেকাংশে এর পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল । সমাজজীবনে মানুষকে পরিবর্তনশীলতার নিয়ম মেনে অগ্রসর হতে হয়।
সামাজিক পরিবর্তনের রৈখিক মতবাদ (Lineary theory on social change) : সাধারণত সামাজিক পরিবর্তনের রৈখিক মতবাদের মূল বক্তব্য হলো সমাজের বিভিন্ন অংশে প্রতিনিয়ত যে পরিবর্তন ঘটে তা স্থির নয় অর্থাৎ বিরামহীন। আর এ পরিবর্তনের মধ্যে বর্তমানের পরিবর্তন বা অতীত বা ভবিষ্যতের পরিবর্তন প্রতিটিই অনন্য। একটির
সাথে অন্যটির মিল পাওয়া দুরূহ। রৈখিক মতবাদে প্রধানত সামাজিক পরিবর্তনের মূল কারণসমূহ বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়। এ মতবাদের বিশ্বাসীদের মধ্যে অগাস্ট কোঁৎ, হাবার্ট স্পেনসার, হব হাউস, ট্যালকট পারসন, কাল মার্কস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। মূলত তাঁরা প্রত্যেকেই সামাজিক পরিবর্তনকে ইতিহাসের ধারায় একটা বাস্তবধর্মী সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া তাঁরা যে ধারণা করেছেন তা বিশেষ করে সেইন্ট সিমন ও কনডোর সেটের ধারণাকে অনুসরণ করেছেন। নিম্নে সংক্ষেপে সমাজ পরিবর্তনের রৈখিক মতবাদের অনুসারী বিভিন্ন তাত্ত্বিকের বক্তব্য উপস্থাপন করা হলো :
ক. অগাস্ট কোঁৎ (August Comte) : সামাজিক পরিবর্তনের সামাজিক রূপ কোঁতের তত্ত্বে পাওয়া যায়। তিনি সামাজিক পরিবর্তন বলতে বুঝিয়েছেন চেতনার বহিঃপ্রকাশকে। এ চেতনাকে তিনি তিন ভাগে আলোচনা করেছেন। এর নাম দিয়েছেন Law of three stages. নিম্নে Comte এর Law of three stages সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

  1. ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধীয় স্তর (Theological stage) : এটি মানুষের জ্ঞান বিকাশের প্রাথমিক স্তর। এ স্তরে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো জ্ঞান মানুষ অর্জন করতে পারে নি। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের জীবন পরিচালিত হতো। মানুষের সকল কর্ম, আদর্শ, বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করতো ধর্ম।
  2. অধিবিদ্যা সম্বন্ধীয় স্তর (Metaphysical stage) : এ স্তরে এসে মানুষ আইন ও রাষ্ট্র গড়ে তোলে। মানুষ বিশ্বাস করতে শেখে যে, ধর্মের বাইরেও জীবন পরিচালনা করা যায়।
  3. দৃষ্টিবাদী স্তর (Positive stage) : এ স্তরে এসে মানুষের জ্ঞানের সামগ্রিক বিকাশ ঘটে। যৌক্তিকতার নিরিখে মানুষ সবকিছুর বিচার করতে শেখে।
    খ. হার্বার্ট স্পেনসার (Herbert Spencer) : August Comte এর ধারণাকে Herbert Spencer চূড়ান্ত রূপ প্রদান করেন। তবে তাঁর তত্ত্ব কোঁৎ এর তত্ত্বের চেয়ে ব্যাপক এবং আরো বেশি তথ্যসমৃদ্ধ। তিনি সমাজ পরিবর্তনের রৈখিক মতবাদের সমর্থন করে বলেন-
    জীবদেহের সাথে সমাজের তুলনা চলতে পারে এবং জীবের ক্রমবিকাশের সাথে সমাজের তুলনা সম্ভব। অজৈব থেকে জৈব এবং জৈব থেকে অজৈব পর্যায়ে বিবর্তন ঘটছে।
    মানবসমাজ সহজ, সরল অবস্থা থেকে ক্রমে জটিল পর্যায়ে বিবর্তন হয়।
    গ. হবহাউজ (Hobhouse) : হবহাউসের মানবসমাজের বিকাশ বা মানব চৈতন্যের বিকাশের আলোচনা অনেকাংশে Comte ও Spencer এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তিনি মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও বিজ্ঞানকে সামাজিক পরিবর্তন ব্যাখ্যায় আলোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি পাঁচটি পর্যায় চিহ্নিত করেছেন। যা নিম্নরূপ :
    বর্বর দশা থেকে ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন পর্যায় ডিঙ্গিয়ে মানবসমাজ সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলে। তাঁর মতে, সামাজিক বিবর্তন ও সামাজিক প্রগতির মধ্যে পার্থক্য নেই এবং সামাজিক বিবর্তন ধীরে তবে ক্রমাগতভাবে নির্দিষ্ট পর্যায় অতিক্রম করে এগিয়ে চলে। তাঁর মতে, এ এগিয়ে চলা অনেকটা স্বয়ংক্রিয়। এর জন্য পরিকল্পনার তেমন প্রয়োজন নেই।
    অনক্ষর সমাজে ভাষার বিকাশ। প্রাচীন ব্যাবিলন, মিশর ও চীনের বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনার উন্মেষ। পরবর্তীকালে প্রাচ্যে এ চেতনার প্রতিফলন ও বিকাশ। গ্রিসে সুসংহত ও যুক্তিনির্ভর চিন্তার বিকাশ।
    ৫. ষোড়শ শতক থেকে আধুনিক চিন্তার বিকাশ।
    ঘ. এমিল ডুরখেইম (Emile Durkheim) : ডুরখেইম সামাজিক পরিবর্তন ব্যাখ্যায় সমাজে দু’ধরনের সংহতির কথা বলেছেন । যথা : যান্ত্রিক সংহতি (Mechanical solidarity) ও জৈবিক সংহতি (Organic solidarity)। তিনি বলেছেন, যান্ত্রিক সংহতি জৈবিক সংহতিতে রূপান্তরিত হয়। তিনি দেখিয়েছেন পূর্বের সমাজে জনগণের মধ্যে যে সংহতি ছিল তা যান্ত্রিক বা যন্ত্রের ন্যায়। প্রাক শিল্পযুগীয় সমাজে জনসাধারণের মধ্যে অভিন্ন কাজকর্ম, চিন্তাধারা, আচার আচরণ ও জীবনাদর্শ থাকার ফলে সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠিত হতো। কিন্তু শিল্প সমাজের মানুষের আচার আচরণ ও কাজকর্মে পরিবর্তন আসে। শ্রমবিভাগ সামাজিক সংহতি সুদৃঢ় করতে সাহায্য করে। এটি হলো আধুনিককালের জৈবিক সংহতি।
    ঙ. ট্যালকট পারসল (Talcott Parsons) : ট্যালকট পারসন্সও মানবসমাজ পরিবর্তনে রৈখিক মতবাদ বা তত্ত্ব প্রদান করেন । আর এ লক্ষ্যে তিনি মানবসমাজকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা :
    ১. আদিম সমাজ,
    ২. মধ্যবর্তীকালীন সমাজ ও
    ৩. আধুনিক সমাজ ।
    উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজ এক স্থানে থেমে নেই। পৃথিবীর সমগ্র সমাজ.একই নিয়মে পরিবর্তিত না হলেও পরিবর্তনের কতকগুলো নিয়ম মেনে চলে। বিভিন্ন বিপ্লব, সংস্কার এসব পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে। মানুষকে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে খাপখাইয়ে নিতে হয়। নতুনভাবে সমাজকে সাজাতে পরিবর্তনকে মানুষ মেনে নেয়।