উত্তর ঃ ভূমিকা : সামাজিক নীতির সুনির্দিষ্ট পরিধি নির্ধারণ করা কঠিন। কার্যত একটি রাষ্ট্রের সামাজিক নীতির পরিধি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সামাজিক উন্নয়নের মাত্রা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুশীলনের মাত্রা, জাতীয় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সাহায্য ও দাতা দেশের স্বার্থ এমন কি ক্ষেত্র বিশেষে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর ।
→ সামাজিক নীতি ঃ সামাজিক নীতি হচ্ছে সেসব সুশৃঙ্খল নিয়ম-কানুন বা নির্দেশ যা সমাজ কল্যাণমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করা হয়।
→ প্রামাণ্য সংজ্ঞা : সামাজিক নীতির কিছু গুরত্বপূর্ণ সংজ্ঞা প্রদান করা হলো-
Encyclopedia of Social Work in India-এর ভাষায়, “সামাজিক নীতি প্রণয়ন করা হয় সামাজিক উদ্দেশ্য নির্দিষ্টকরণ এবং সেই উদ্দেশ্য অর্জনের পর্যাপ্ত সম্পদ সংগ্রহ ও তার বিনিয়োগের প্রকৃতি বা ধরন নির্ধারণের জন্য।” অধ্যাপক টিটমাস এর মতে, “জনগণের কল্যাণার্থে সরকার কর্তৃক স্বতঃস্ফূর্তভাবে গৃহীত নীতিকে সামাজিক নীতি বলে।” অধ্যাপক স্নেক এর মতে, “যেসব নীতি জনকল্যাণের পথ নির্দেশ করে তাকেই সামাজিক নীতি বলা হয়।” The Social Work Dictionary-তে বলা হয়েছে, “সামাজিক নীতি হলো কোনো সমাজের ব্যক্তি দল ও সমষ্টি
এবং সামজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণে পথনির্দেশ দানকারী কার্যক্রম ও বিধি বিধান, যা সামাজিক প্রথা ও মূল্যবোধেরই ফলশ্রুতি। সুতারং বলা যায়, যেসব সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন বা নির্দেশ যা সরকার বা সমাজকর্তৃক সমাজ কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ, পরিচালনা এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য আদর্শ হিসেবে কাজ করে তাকে সামাজিক নীতি বলে ।
→ সামাজিক নীতির পরিধি ঃ সামাজিক নীতির পরিধি ব্যাপক এবং বিস্তৃত। সামাজিক নীতির পরিধি সামাজিক নাতি প্রণয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে সামাজিক নীতির পরিধি তুলে ধরা হলো :
১. শিক্ষা ঃ সামাজিক নীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র হলো শিক্ষা। শিক্ষার সাথে সামাজিক কল্যাণ ও উন্নয়নের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাই শিক্ষা সামাজিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র তথা এটি সামাজিক নীতির পরিধিভুক্ত। এক্ষেত্রে শিক্ষার ধরন এবং পর্যায় প্রয়োজনীয় জনশক্তি, শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং পদ্ধতি, শিক্ষকদের যোগ্যতা
এবং পদ্ধতি, শিক্ষকদের যোগ্যতা,।শিক্ষানীতির জন্য প্রশাসন ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত।
২. স্বাস্থ্য ঃ স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা ও কর্মপন্থা স্বাস্থ্য ও ওষুধ প্রশাসন, স্বাস্থ্য সেবাসমূহের মধ্যে সমন্বয়, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত শিক্ষা, গ্রামীণ ও শহরে স্বাস্থ্য সেবার ধরন, প্রকৃতি, পুষ্টি, শিশু ও মাতৃ-মৃত্যু, প্রজনন স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ইত্যাদি বিষয়গুলো এর অন্তর্ভুক্ত।
৩. সমাজকল্যাণ : সামাজিক নীতি প্রণয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো সমাজকল্যাণ। সমাজকল্যাণমূলক প্রচেষ্টায় বিভিন্ন দিক সামাজিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত। শিশু কল্যাণ, নারী কল্যাণ, যুব কল্যাণ, বৃদ্ধকল্যাণ, বিশেষ অসুবিধাগ্রস্তদের কল্যাণ, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের কল্যাণ ইত্যাদি বিষয়গুলোর সামাজিক
নীতির পরিধিভুক্ত ।
৪. গৃহায়ন ঃ আশ্রয় ষের নৈতিক চাহিদাগুলোর অন্যতম। অথচ তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে গৃহায়ন সমস্যা একটি মারাত্মক সমস্যা। তাই এ রাষ্ট্রগুলোতে গৃহায়ন সামাজিক নীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত। গৃহের ধরন, প্রকৃতি, গৃহ ঋন, গ্রামীণ ও শহর এলাকায় গৃহায়নের জন
্য প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত ভূমি সংস্থানের
ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলো গৃহায়নের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচ্য বিষয়।
৫. কর্মসংস্থান ঃ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই কর্মসংস্থান ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতি রয়েছে। কর্মসংস্থানের ধরন, প্রকৃতি যোগ্যতা কি ধরনের যোগ্যতাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হবে সাধারণ শিক্ষা, নাকি কারিগরী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসংস্থানের জন্য কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। আত্ম-কর্মসংস্থানমূলক কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলো এক্ষেত্রে আওতাধীন ।
৬. দারিদ্র্য বিমোচন ঃ বিশেষ করে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো দারিদ্র্য। দারিদ্র্যপীড়িত জনগণ নিজেরাই শুধু উন্নয়নের সুবিধা থেকে বঞ্চিত নয়। অধিকিন্তু উন্নয়নের পথেও বড় প্রতিবন্ধকতা। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের গতিধারাকে ত্বরান্বিত করতে দারিদ্র্য বিমোচন অপরিহার্য। এক্ষেত্রে দারিদ্র্যের গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল ও কর্মপন্থা নির্ধারণ প্রয়োজন।
৭. অপরাধ ও কিশোর অপরাধ সংশোধন : অপরাধপ্রবণতা আদিম ও সহজাত। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে সমাজ স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রত্যেক সমাজের কাজ। আধুনিক আচরণ বিজ্ঞানীদের নব আবিষ্কার হলো শাস্তি কোনো সমাধান নয়। তাই শাস্তির স্থান দখল করে নিয়েছে সংশোধন। সমাজস্থ মানুষের অপরাধ প্রবণতা কমাতে শাস্তি নয় বরং প্রয়োজন বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়ে অপরাধে লিপ্ত সমাজের সদস্যদের সংশোধন ।
৮. সামাজিক আইন ঃ সমাজের বঞ্চিত, দারিদ্র্যপীড়িত, অসহায় ও বিশেষ।অসুবিধাগ্রস্তদের সামাজিক সুযোগ-সুবিধা
নিশ্চিত, মৌলিক চাহিদা পূরণ, সর্বোপরি তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সামাজিক আইন।অপরিহার্য প্রতিষ্ঠাগত সামাজিআইন সামাজিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত।
৯. সামাজিক নিরাপত্তা : সামাজিক অগ্রগতি রক্ষা বা সমাজের সদস্যদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যে-।কোনো রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্য। অন্যভাবে বলা যায় সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেক নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কোনো রাষ্ট্রের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়।
সামাজিক নীতির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে
সামাজিক নীতি গৃহীত হয় । যার ভিত্তিতে নিশ্চিত হয় জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
১০. রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা ৪ রাষ্ট্র ব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা। বিশেষ করে রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টন কেমন হবে তা নির্ধারিত হয়ে থাকে। তবে তা কার্যকর হয় সামাজিক নীতির মাধ্যমে। সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে সামাজিক নীতি গৃহীত হয়, যার ভিত্তিতে নিশ্চিত হয় জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
উপসংহার।পরিশেষে বলা যায় যে, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা, জটিল পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সামাজিক সমস্যার আধিক্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা, মৌলিক মানবীয় চাহিদার অপূরণ, সীমিত সম্পদ ইত্যাদি কারণে এসব রাষ্ট্রে স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক নীতির পরিধি তুলনামূলকভাবে সীমিত।