অথবা, সামাজিক গবেষণা কিরূপে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে আলোচনা কর। ৯৯%
উত্তর৷ ভূমিকা : বিজ্ঞানী যে যৌক্তিক পদ্ধতিতে সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিষয়াবলি বর্ণনা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাধারণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তাকেই সাধারণ কথায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে। বস্তুত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই বিজ্ঞানের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা ও রক্ষাকারী উপাদান। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মূলত প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিষয়কে যৌক্তিক ও সুনির্দিষ্টভাবে বিশ্লেষণ করে থাকে।
সামাজিক গবেষণা কিভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে : সামাজিক গবেষণাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসারী বলে দাবি করা হয়। নিম্নে সামাজিক গবেষণা কিভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে তা আলোচনা করা হলো :
১. বাস্তবমুখী তথ্যনির্ভরতা : বিজ্ঞান তার সত্য প্রতিষ্ঠায় বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষালব্ধ তথ্যের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সামাজিক গবেষণাও সামাজিক পরিবেশ থেকে বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তথ্যাবলি সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।
২. মূল্যবোধ নিরপেক্ষতা : বিজ্ঞান পক্ষপাতহীন। বৈজ্ঞানিক মূল্যবোধ ছাড়া বিজ্ঞানে অন্য কোন মূল্যবোধের অবস্থান অনুপস্থিত এবং অবাঞ্ছিত। সামাজিক গবেষণা বিভিন্ন ধরনের মূল্যবোধের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারে না। কিন্তু অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে সামাজিক গবেষণা নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে।
৩. প্রাসঙ্গিক ধারণার ব্যবহার : বিজ্ঞান তার অনুসন্ধান কাজে বিশ্লেষণাধীন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধারণা বিবেচনা ও ব্যবহার করে থাকে। আর এতে করে চিন্তা ও সত্যের পারম্পর্য বজায় থাকে। সামাজিক গবেষণা সমাজ সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ের উপর অনুসন্ধান কাজ চালাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর প্রভাব বিবেচনার চেষ্টা করে।
৪. সর্বজনীন : বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত সর্বজনীন। সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত সামাজিক বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তবলি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান প্রদত্ত সিদ্ধান্তের মতো ততটা সুনিশ্চিত নয়। কেননা সামাজিক বিষয় অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। তাই সামাজিক গবেষণালব্ধ সকল সিদ্ধান্তের বিশ্বজোড়া সমগ্রহণযোগ্যতা তেমনটা নেই। তবে সীমিত ক্ষেত্রে হলেও সামাজিক গবেষণা
তুলনামূলকভাবে তার সিদ্ধান্ত সাধারণীকরণের চেষ্টা করে। এর ফলশ্রুতিতে সমাজভেদে বিভিন্ন সাধারণ অবস্থার প্রকৃতি সর্বজনীন করা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে। পরিমাপের দুর্বলতাই সমাজ গবেষকের সিদ্ধান্ত সাধারণীকরণে নমনীয় করে রাখে।
উদ্দেশ্যমুখী : বিজ্ঞান সবসময়ই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখে এগিয়ে চলে। সামাজিক গবেষণাও সামাজিক সত্য উন্মোচনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
৬. নিয়ন্ত্রণ : বিজ্ঞান সুনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সত্য উদঘাটনে বিশ্বাসী। সমাজ গবেষণা সমাজ সম্পর্কিত বিষয়াবলিকে গবেষণাগারে আবদ্ধ করতে পারে না। তবে এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। সফলজনক এসব কৌশলের প্রয়োগ সমাজ গবেষককে আপেক্ষিকভাবে নিয়ন্ত্রণক্ষম করে তোলে।
৭. পরিমাপ : বিজ্ঞানের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হলো তার প্রাপ্ত তথ্যের পরিমাপযোগ্যতা। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো সামাজিক গবেষণা তার সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারে না। তবে চুলচেরা পরিমাপ না করতে পারলেও তুলনামূলক পরিমাপ করা সমাজ গবেষকের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে থাকে। সত্যিকার অর্থে, সমাজ গবেষণার প্রাথমিক ও প্রধান দুর্বলতাই হচ্ছে মাত্রাগত পরিমাপে অপারগতা। অর্থাৎ কতটুকু দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেলে কতটুকু অপরাধ প্রবণতা বাড়বে, তা সমাজ গবেষক পরিমাপ করতে পারেন।
৮. পুনরাবৃত্তি : বিজ্ঞান প্রাপ্ত সত্যের যথার্থতা সম্পর্কে একই
ধরনের ফলাফলের পুনরাবৃত্তির কথা ঘোষণা করে থাকে। সামাজিক গবেষণা এক্ষেত্রে তার সত্যের পুনরাবৃত্তির সম্ভাব্যতার কথাই মাত্র তুলে ধরতে সক্ষম। অর্থাৎ পরীক্ষণপাত্র বা সামাজিক উপাদানের উপর সমাজ গবেষকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না থাকাতে শর্তসাপেক্ষে গবেষণার পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব হয়।
৯. পূর্ববলন : প্রাপ্ত তথ্য বা সত্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞান নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে। সমাজ গবেষক সামাজিক বিষয় সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাবনা নির্ভর ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে। যেমন- অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলেও দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেলে অপরাধ প্রবণতাও বৃদ্ধি পাবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, সামাজিক গবেষণা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির যাবতীয় বৈশিষ্ট্য অনুসরণের চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু সদা পরিবর্তনশীল এবং গুণগত সামাজিক বিষয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের ধারা সম্পূর্ণভাবে বজায় রাখা সম্ভবপর হয় না। তবে বর্তমান কালে বিভিন্ন কৌশল উদ্ভাবন ও প্রয়োগের ফলে সমাজ গবেষণাপ্রাপ্ত সিদ্ধান্ত অধিক মাত্রায় পরিমাপযোগ্য এবং পূর্ববলন ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে। সমাজ গবেষণার এ ধরনের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির সুবাদে একে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।