সামাজিক গতিশীলতার কারণ সমূহ আলোচনা কর।

অথবা, সামাজিক গতিশীলতার কারণসমূহ বিশ্লেষণ কর।
অথবা, সামাজিক গতিশীলতার উপাদানসমূহ আলোচনা কর ।
উত্তর ভূমিকা :
মানবসমাজ গতিশীল এবং গতিশীল পৃথিবীর সব মানুষ একই পদমর্যাদা ভোগ করে না। কোন ব্যক্তি যে সমাজে বসবাস করে সেখানে নিজের অবস্থানের একটা তুলনামূলক চিত্র সে নিজেই বুঝতে পারে। অর্থাৎ সে কারও চেয়ে বেশি আবার কারো চেয়ে কম মর্যাদা ভোগ করে। এভাবে কোন ব্যক্তি সমাজের যাদের সাথে জড়িত থাকে
তাদের সাথে তুলনা করেই ব্যক্তির ঊর্ধ্বমুখী বা নিম্নমুখী গতিশীলতা নির্ণয় করা হয়। সামাজিক মর্যাদার এ তারতম্য বা পরিবর্তনকে বুঝাতে সামাজিক গতিশীলতা বা Social mobility শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
সামাজিক গতিশীলতার কারণ (Causes of social mobility) : সামাজিক গতিশীলতার অনেক কারণ আছে। বিশেষ বিশেষ কারণ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. শিল্পায়ন (Industrialization) : সামাজিক গতিশীলতার অন্যতম কারণ হলো শিল্পায়ন। কৃষিভিত্তিক সমাজের মানুষের জীবন স্থবির। কারণ কৃষিকাজ করতে গিয়ে মানুষকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয় না। বস্তুত কৃষির আবিষ্কারের সাথে সাথে মানুষের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটেছিল এবং মানুষ জমির সাথে বাধা হয়ে পড়েছিল। শিল্পায়নের ফলে মানুষের এ স্থবির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কেননা শিল্পকারখানাগুলো সাধারণত শহরে বা শহরের নিকটে কোথাও গড়ে উঠে। যারা এ শিল্পায়নের সাথে যুক্ত তাদেরকে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে হয়। এভাবে সমাজে যতই শিল্পায়নের প্রসার ঘটেছে ততই সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
২. শহরায়ন বা নগরায়ন (Urbanization) : সামাজিক গতিশীলতার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো শহরায়ন। শিল্পায়ন এবং নগরায়ন এ দু’টি ঘটনা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। সমাজে যতই শিল্পায়নের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই নগরায়ণের হারও বেড়ে যাচ্ছে। নগরায়ণের প্রসার মানুষকে গতিশীল করে তুলছে। কেননা নগর মানুষকে জীবিকা দিচ্ছে, দিচ্ছে নতুন নতুন সুযোগ সুবিধা। প্রতিদিনই মানুষ নদীর ভাঙন, ব্যাপক দারিদ্র্য কোন কোন ক্ষেত্রে টাউট শ্রেণির দৌরাত্ম্যে জমিজমা হারিয়ে নদীর স্রোতের মতোই বেঁচে থাকার তাকিদে শহরে আসছে। শুধুমাত্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেই নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও মানুষ কাজের সন্ধানে নগরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এভাবে মানুষের নগরের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা সামাজিক গতিশীলতাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করছে। ঢাকা শহরে প্রতি মাসে পঁচিশ হাজার লোক জীবন ও জীবিকার সন্ধানে আসছে।
৩. প্রযুক্তিগত উন্নয়ন (Technological development): বর্তমান বিশ্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে সমান তালে উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যতই বিজ্ঞানের প্রসার ঘটছে ততই মানুষের জীবনযাত্রা আধুনিকতর হচ্ছে। একই সাথে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে উন্নয়ন কৌশলও পরিবর্তিত হচ্ছে। বর্তমানে কৃষিক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এভাবে যত দ্রুত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হচ্ছে মানুষের সামাজিক গতিশীলতাও তত দ্রুত হচ্ছে। বেশি আয়ের জন্য অথবা জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নের জন্য মানুষ এখন খুব সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারে। কেননা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নততর হয়েছে। ফলে এখন মানুষ তার ভাগ্যকে মেনে নিচ্ছে না বরং উন্নত প্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে মানুষ তার জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন চাচ্ছে।

  1. পেশা (Occupation) : পেশা সামাজিক গতিশীলতার অন্যতম নির্ধারক। সমাজে বিভিন্ন ধরনের পেশার প্রচলন রয়েছে। মানুষ তার দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী এ পেশাগুলোর সাথে যুক্ত হচ্ছে। কিছু কিছু পেশা আছে যা মানুষকে দ্রুত উন্নত অবস্থার দিকে নিয়ে যায় বা দ্রুত মানুষের পদমর্যাদাকে পরিবর্তনে সহায়তা করে। আবার কিছু কিছু পেশা আছে যা মানুষের পদমর্যাদা ও অবস্থান পরিবর্তনে কোন ভূমিকা রাখে না। অন্যদিকে, মানুষের আরো কিছু পেশা আছে যা মানুষের পদমর্যাদাকে নিম্নমুখী করে তোলে। যেমন- যেসব ব্যক্তি ব্যবসার সাথে জড়িত তারা খুব দ্রুত নিজেদের পদমর্যাদাকে পরিবর্তন করতে পারে। একজন ব্যবসায়ী রাতারাতি ঊর্ধ্বমুখী বা নিম্নগামী মর্যাদায় চলে যেতে পারে। কিছু কিছু পেশা আছে যেখানে ব্যক্তির ভূমিকা গতিশীল নয়। এ ধরনের পেশা বহুদিন ধরে ব্যক্তিকে একই পদমর্যাদা দিয়ে যায়।
    ৫. সামাজিক মুক্ত বা বন্ধাবস্থা : মুক্ত ও প্রতিযোগিতাময় সমাজে খুব স্বাভাবিকভাবেই গতিশীলতা বেশি। নবীনদের সৃজনশীল কাজকর্মকে যে সমাজে উৎসাহিত করা হয় সেখানে গতিশীলতা বেশি। সামাজিক গতিশীলতা নির্ভর করে সমাজ মুক্ত না বদ্ধ তার উপর।
    ৬. ব্যক্তির অন্তর্মুখিতা ও বহির্মুখিতা : বহির্মুখী ব্যক্তিত্ব সামাজিক গতিশীলতার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। বহির্মুখী ব্যক্তিত্বের লোক বাইরের জগৎ সম্পর্কে উৎসাহী এবং যে কোন ঝুঁকি গ্রহণ করে জীবনে প্রতিষ্ঠা আনতে উদগ্রীব থাকে। আর যারা ঘরকুনো স্বভাবের লোক, বাড়ি ছেড়ে ঝুঁকি গ্রহণ করে কোন পেশায় অংশগ্রহণে আগ্রহ দেখায় না তারা অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের লোক। এদের জীবনে ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতা খুব কমই পরিলক্ষিত হয়।
    ৭. পরিবেশ : ব্যক্তির পারদর্শিতা ও প্রয়াস ছাড়াও পরিবেশ সামাজিক গতিশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন- অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতি কারো জীবনে ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতা আনয়নে সহায়তা করতে পারে। কোন বিশেষ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কারো ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত ভাগ্য উন্নয়ন সম্ভব হতে পারে। আবার পরিবেশ কারো প্রতিকূলেও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কেউ তার সামাজিক অবস্থান উচ্চে নিতে পারে না। এমনকি কাউকে হয়তো নিম্নগামী গতিশীলতার ফল ভোগ করতে হতে পারে।
    ৮. শিক্ষা : শিক্ষা মানুষের জীবনে সাধারণত ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতা আনয়ন করে। একজন ব্যক্তি শিক্ষিত হলে অর্থাৎ বি.এ, বি.এস.এস, এম.এ. এম.এস.এস বা যে কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তার পূর্বের চেয়ে (যখন শিক্ষিত ছিল না) বেশি সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে। আর এজন্য শিক্ষা লাভের প্রতি বর্তমানে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। যে কোন ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি আসনের বিপরীতে প্রতিবছর ২০-৩০ বা তারও বৈশি ছাত্রছাত্রী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে।
    উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সামাজিক গতিশীলতার মধ্য দিয়েই বর্তমান পৃথিবী আধুনিক রূপ লাভ করছে। এক সময় মানুষ গাছের ডালে, পাহাড়ের গুহায় বসবাস করেছে। আজ সমাজের গতিশীলতার মধ্য দিয়ে মানুষ বৈদ্যুতিক আলোক খচিত গগনচুম্বী অট্টালিকায় বসবাস করছে। পৃথিবীর অনেক মহামানব অতিসামান্য অবস্থান থেকে অতি উচ্চ মর্যাদায় আসতে পেরেছেন। এর সবকিছুই গতিশীলতার ফল। পৃথিবী আজ যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তাকে বলা যায় গতিশীলতার চরমরূপ। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণার উন্নয়নের ফলে সমাজ অতিদ্রুত পরিবর্তনশীলতায় পর্যবসিত হচ্ছে। তাই বলা যায়, “সামাজিক গতিশীলতা” একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাববার প্রভাবে আমরা আধুনিক সভ্যতায় এসে নানামুখী সুবিধা ভোগ করতে পারছি।
https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b7%e0%a6%b7%e0%a7%8d%e0%a6%a0-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4/