অথবা, সামাজিক কার্যক্রমের ধরনসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক কার্যক্রমের কাঠামোগুলো বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক কার্যক্রমের গঠন আলোচনা কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : সামাজিক কার্যক্রমের মডেল বা ধরনগুলো সর্বজনস্বীকৃত নয়। মডেলগুলো সাধারণ অনুমান এবং বিভিন্ন উন্নয়ন ব্যবস্থা থেকে সংগৃহীত হয়েছে। ফলে সামাজিক কার্যক্রম নানাভাবে পরিচালিত ও বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে মনীষীগণ বিভিন্নভাবে তাদের মতামত ব্যাখ্যা করেছেন। এ প্রসঙ্গে ড. আর. আর. সিং (Dr. R.R.
Singh) বলেন, “সামাজিক কার্যক্রমের মডেলগুলো সমষ্টি সংগঠন, সমষ্টি উন্নয়ন, সামাজিক আন্দোলন এবং গান্ধীবাদী
সমাজকর্ম সাহিত্য থেকে অনুমানের ভিত্তিতে সংগ্রহ করা হয়েছে।” (HY Siddiqui)। ফলশ্রুতিতে পেশাদার সামাজিক কার্যক্রম কর্মীর অনুশীলন উপযোগী মডেল নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
সামাজিক কার্যক্রমের মডেল/ধরনসমূহ : সামাজিক কার্যক্রমের মডেল ও ধরন সম্পর্কে গ্যাব্রিয়েল এ এ ব্রিটো বক্তব্য প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন, সামাজিক কার্যক্রম উপযোগী মডেল মুখ্যত ২টি। যথা :
অভিজাতমুখী সামাজিক কার্যক্রম (Elitist social action model)
খ. জনমুখী সামাজিক কার্যক্রম মডেল (Popular social action model)
প্রতিটি মডেলেরই আবার রয়েছে তিনটি করে উপমডেল। (H.Y siddiqui)
ক. অভিজাত মুখী সামাজিক কার্যক্রম মডেল (Elitist Social Action Model) : অভিজাতমুখী সামাজিক কার্যক্রম বলতে সমাজের নেতৃস্থানীয় বা অভিজাত শ্রেণির উদ্যোগে পরিচালিত ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কল্যাণকে বুঝায়। অভিজাতমুখী সামাজিক কার্যক্রম মডেলকে তিনটি উপমডেলে ভাগ করা যায়। যথা :
১. আইনানুগ কার্যক্রম মডেল (Legislative action model)
- অর্থনৈতিক সমর্থনমুখী মডেল (Economic sanction model) এবং
সরাসরি শক্তিপ্রয়োগ মডেল (Direct physical model) নিম্নে এসব উপমডেলগুলো আলোচনা করা হলো :
১. আইনানুগ কার্যক্রম মডেল (Legislative action model) : সমাজের নেতৃস্থানীয়রা সমমনা ব্যক্তি, আইন প্রণেতা (সাংসদ) এবং বিভিন্ন সংস্থার সাথে মিলিত হয়ে আইনানুগ কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় জনকল্যাণ সাধন করা হয়। এ উপমডেলের মাধ্যমে জনগণের সমস্যা প্রতিরোধে প্রচেষ্টা চালানো হয়। সামাজিক আইন প্রণয়ন, সামাজিক নীতির সংশোধন ও সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ করাই এ কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য। এ কার্যক্রমে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
i. বিজ্ঞানভিত্তিক সম্ভাব্য প্রস্তাব প্রণয়ন।
ii. সমস্যার গুরুত্ব এবং তা সমাধানের গুরুত্ব সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহের জন্য কমিশন গঠন করা।
iii.জনমত তৈরি।
পরীক্ষণের মাধ্যমে নতুননীতির যথাযথ বাস্তবায়নের সহায়তা।
V. প্রভাবিত করা, এজন্য পারিশ্রমিক ভিত্তিক করা।
vi. সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সভা করা এবং
vii. বিধি/আইন ব্যবস্থার মাধ্যমে অনুমোদন লাভ করা।
২. অর্থনৈতিক সমর্থনমুখী মডেল (Economic sanction model) : সামাজিক কার্যক্রমের এই ব্যবস্থায় সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তার সুযোগ সুবিধা জনকল্যাণে ব্যবহার করে। এজন্য তারা বিশেষ ক্ষেত্রে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে প্রভাবিতকরণ প্রয়োজনে জোর প্রয়োগ করা হয়। এ জাতীয় উপমডেল সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা হয়। তবে পেশাদার সামাজিক কার্যক্রমে এ ধরনের মডেলের ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ ও সমাজকর্মের দর্শন বহির্ভূত ।
৩. সরাসরি শক্তিপ্রয়োগ কৌশল (Direct physical model) : সরাসরি শক্তিপ্রয়োগ কৌশলের আরেক নাম সামাজিক বিপ্লব বা গণবিপ্লব। এ জাতীয় উপমডেল অনুযায়ী অভিজাত শ্রেণি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রচেষ্টা চালায়। অত্যাচারিত, শোষিত, বঞ্চিত, ঔপনিবেশিক দেশে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দিয়ে অথবা শাস্তিদানের ভয় দেখিয়ে এই প্রক্রিয়ায় জনকল্যাণ সাধন করা হয়। যদিও এ ধরনের পন্থা সমাজকর্ম দর্শন বহির্ভূত। যেমন- ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে এ ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে বিপ্লবী দল তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছিল। আন্দোলনের মাধ্যমে সমস্যা সৃষ্টিকারী এ জাতীয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে।
খ. জনমুখী সামাজিক কার্যক্রম মডেল (Popular social action model) : জনমুখী সামাজিক কার্যক্রম মডেল পরিচালিত হয় কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি কর্তৃক জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ও ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এ সামাজিক কার্যক্রমে জনগণই মূল ভূমিকা পালন করে থাকে। এ প্রসেঙ্গ ব্রিটো বলেছেন, “জনমুখী সামাজিক কার্যক্রম হচ্ছে সমঝোতা
বা সংঘাতের পথে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজকল্যাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য চেষ্টা করা। এ ধরনের
কার্যক্রমের মাধ্যমে অন্যায় অবিচার, সংস্থা, নীতি, কর্মপদ্ধতি ও অন্যায়কারী এজেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে অভিজাত শ্রেণি থাকে পথপ্রদর্শক হিসেবে। প্রচলিত সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন সাধন, নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করা এর মূল লক্ষ্য।” (H.Y Siddiqui ) জনমুখী সামাজিক কার্যক্রমের তিনটি উপমডেল রয়েছে। এগুলো হলো :
সরাসরি উদ্বুদ্ধকরণ মডেল (Direct mobilization model)
১. দ্বান্দ্বিক উদ্বুদ্ধকরণ মডেল (Dialectical mobilization model)
বিবেকবোধ সৃষ্টিকরণ মডেল (Conscientization model)
নিম্নে এসব মডেলসমূহ বর্ণনা করা হলো :
১. সরাসরি উদ্বুদ্ধকরণ মডেল (Direct mobilization model) : এ ধরনের মডেলে জনগণকে আকৃষ্ট করা এবং জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। এক্ষেত্রে সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করে এবং একজন জনমত গঠন করেন। তারা ধর্মঘট, প্রতিবাদ, আন্দোলন প্রভৃতি কৌশলের আশ্রয় নিয়ে জনগণকে সমস্যা সমাধানের উদ্বুদ্ধ করেন। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সমস্যার মূল কারণ বিশ্লেষণ, এজন্য নীতি নির্ধারণ ও কর্মপ্রক্রিয়া ঠিক করেন। তাঁরা মূল লক্ষ্য
অর্জনের জন্য জনগণকে আকৃষ্ট করেন এবং কাজে গতি সঞ্চারকরণের ব্যবস্থা করেন।
২. দ্বান্দ্বিক উদ্বুদ্ধকরণ মডেল (Dialectical mobilization model) : সামাজিক কার্যক্রমের এটি একটি অন্যতম মডেল হিসেবে বিবেচিত। এর মূল লক্ষ্য হলো-তর্কবিতর্ক সৃষ্টি, পক্ষ বিপক্ষ আহ্বান, পারস্পরিক সংঘাত প্রভৃতির মাধ্যমে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা, এর ফলে যৌক্তিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। সামাজিক কার্যক্রমের এই মডেলে যুক্তিপূর্ণ বিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে পক্ষ ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে সমঝোতা গঠিত হয়। এক্ষেত্রে সুচিন্তিত যুক্তি কল্যাণকর (Thesis) এবং অন্য পক্ষ বিরোধী (Antithesis) ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ফলশ্রুতিতে যে সমঝোতা বা ঐকমত্য গঠিত হয় তা Synthesis পরিচিত। সামাজিক কার্যক্রমের এ মডেলে জনগণের কল্যাণে সমাজকর্মীগণ ইতিবাচক ফল পেয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে ব্রিটো বলেছেন, “Dialectical model promoting conflict to exploit the
contradictions in a system, with the belief that a better system will emerge as a result.”
৩. বিবেকবোধ সৃষ্টিকরণ মডেল (Conscientization model) : সামাজিক কার্যক্রমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মডেল হলো বিবেকবোধ সৃষ্টিকরণ মডেল। এ মডেলের মূল কথা হলো অত্যাচারী ও অত্যাচারকারী উভয়ের বিবেকবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে সামাজিক কার্যক্রম পরিচালিত করা। এক্ষেত্রে শিক্ষার মাধ্যম নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষ সচেতন হবে, অন্যদিকে অত্যাচারকারী ও নির্যাতনকারীদেরও বিবেকবোধ জাগ্রত হয়ে সংশোধিত হবে। এ মডেলের অনুসারী হলেন ব্রাজিলের পাওলো ফিয়েরে (Paulo Friere)। তিনি নিপীড়নের সংশোধনে শিক্ষা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা করেন (Pedagogy of the Oppressed)। তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়ায় জনগণ শিক্ষণের মাধ্যমে শুধু আক্ষরিক জ্ঞান অর্জন নয়, তারা স্বাধীন ও মুক্ত হওয়ার কৌশল অর্জন করবে। এজন্য তিনি জনগণের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে সামাজিক কাঠামোকে বিশ্লেষণ করতে আমন্ত্রণ জানান। যার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় । H.Y. Siddiqui: Social Work and Social Action)
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, সামাজিক কার্যক্রমের এসব মডেল সামাজিক উন্নয়ন তথা সামাজিক সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এসব মডেলের মধ্যে কতিপয় পার্থক্য থাকলেও তাদের লক্ষ্য হলো পরিকল্পিত ও ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়ন। এক কথায় সমাজের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা মডেলসমূহের মূল লক্ষ্য ।