অথবা, সাংবিধানিক বা শাসনতান্ত্রিক সরকারের বিশেষ সমূহ কী কী?
অথবা, নিয়মতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, নিয়মতান্ত্রিক সরকারের বিভিন্ন দিকসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : সংবিধান বিশ্বের সকল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষভাবে অপরিহার্য একটি দলিল। কেননা সংবিধানের ভিত্তিতেই একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, সরকার গঠিত হয়, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টিত হয়, সরকারি কাজকর্ম পরিচালিত হয়। আর এ সংবিধানে সন্নিবেশিত বিধিবিধান অনুসারে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, ভানকল্যাণের লক্ষ্যে পরিচালিত সরকারই সাংবিধানিক সরকার। সাংবিধানিক সরকারের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
সাংবিধানিক বা শাসনতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ : সাংবিধানিক বা নিয়মতান্ত্রিক সরকার নানাবিধ উপাদান ও বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
১.সংবিধানের প্রাধান্য: সাংবিধানিক সরকারের ক্ষেত্রে সংবিধানের প্রাধান্য বজায় রাখা হয়। অর্থাৎ এ সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম সংবিধান নির্ভর। সংবিধান জনগণের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের সংরক্ষক।
২. ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা: ‘Constitutionalism means to keep the government in order’. “সাংবিধানিকতাবাদের মূল কথা হলো সরকার চলবে। বিধিবদ্ধভাবে।” অর্থাৎ সাংবিধানিক সরকারের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে। লাগামহীন ক্ষমতা ব্যবহারে সাংবিধানিক সরকার পরিচালিত হতে পারে না।
৩. স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা সাংবিধানিক সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ সরকারের কার্যপদ্ধতি ঘন ঘন বা ইচ্ছামাফিক পরিবর্তন করা যায় না। সংবিধানে যেসব বিধি লিপিবদ্ধ থাকে তা অবশ্যই হঠাৎ করে সংবিধানবিরোধী বলে গণ্য হবে না।
৪. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : নিয়মতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় ব্যক্তির পরিবর্তে আইনের প্রাধান্য রক্ষিত হয়। যেখানে আইনের শাসন নেই সেখানে সাংবিধানিক সরকার চলতে পারে না। এ সরকার হবে আইনের। তাই বলা যায়, “Limitation of the government by law.”
৫. দায়িত্বশীলতা : এটা দায়িত্বশীল সরকার। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য সরকার সকল মাধ্যমের কাছে দায়ী থাকবে। তাছাড়া সাংবিধানিক সরকার শাসিত জনগণের কাছে নিয়মমাফিক সবসময়ই দায়ী থাকে।
৬. বিচার বিভাগের প্রাধান্য : বিচার বিভাগের প্রাধান্য সাংবিধানিক সরকারের অপর একটি বৈশিষ্ট্য। বিচার বিভাগ আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করে এটা সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা নির্ধারণ করে। এভাবে বিচার বিভাগ সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে কার্যসম্পাদন করে থাকে।
৭. মৌলিক অধিকার : সাংবিধানিক
সরকার জনগণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করে । জনগণের মৌলিক অধিকার সরকারের নিকট আমানত হিসেবে সংরক্ষিত থাকে। এরূপ সরকার জনগণের স্বার্থকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার স্বেচ্ছাচারের হাত থেকে রক্ষা করে।
৮. ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা : সাংবিধানিক সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সামাজিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। সরকার রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে বিভিন্ন স্বার্থকামী গোষ্ঠীর মধ্যে ভারসাম্য আনয়ন করে। অধ্যাপক ফ্রেডারিকের ভাষায়, “It is no equipoise of mechanical weight, but rather moving equilibrium of a kalcidoscopic.
স্বার্থের সমন্বয়।”
৯.গণতান্ত্রিক সরকার: সাংবিধানিক সরকার কোন প্রকার স্বৈরাচারী ক্ষমতার উপর প্রতিষ্ঠিত নগ্ন। এ সরকার মূলত PEC বিরোধী ও গণতান্ত্রিক সরকার। জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার ভোগ করে থাকে।
১০. ক্ষমতা কটন ক্ষমতার বণ্টন বা স্বতন্ত্রীকরণ: নিয়মতান্ত্রিক সরকারের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সকল ক্ষমতা একটি বিভাগের হাতে থাকলে সেই বিভাগের উপর কার্যত কোন বাধানিষেধ থাকে না। সাংবিধানিক সরকারের মধ্যে এবং আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করে দেয়া হয়।
১১. প্রতিশীলতা নিয়মতান্ত্রিক সরকার পরিবর্তনশীল অবস্থার সাথে খাপখাইয়ে নিতে পারে। স্বৈরতান্ত্রিক কিংবা রাজতান্ত্রিক ইত্যাদি সরকার ব্যবস্থায় এ সরকার ব্যবস্থার ন্যায় নীতিশীলতা অনুমেয় হয় না।Prof. Friedrick এর মতে, “Change and development are not something to be feared but are of the very ware and woof of modern constitutionalism.”
১২. জনমত : জনমত নিয়মতান্ত্রিক সরকারের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। জনমতের প্রাধান্য অবশ্যই স্বীকৃত হবে। কে. সি. ভূঁইয়ার বলেন, “সাংবিধানিক প্রশ্নে জনগণের মতামতকে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে।
১০. সুনির্দিষ্ট শাসন পদ্ধতি : সাংবিধানিক সরকার, সংবিধান, আইন ও অন্যান্য রীতিনীতি অনুসারেই তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে। অর্থাৎ এরূপ সরকার একটি সুনির্দিষ্ট শাসন পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে।
১৪. লিখিত সংবিধান : সাংবিধানিক সরকারে সংবিধান লিখিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কারণ সংবিধান লিখিত হলে অনুপূর্ণ ও সরকার উভয়ই স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকে। তাই সাংবিধানিক সরকারের সাফল্যের জন্য সংবিধান লিখিত হওয়া আবশ্যক।
১৫. নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তর : সাংবিধানিক সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর। এরূপ শাসনব্যবস্থায় সরকার জোরপূর্বক ক্ষমতা ধরে রাখে না। কিংবা বিরোধী দল ক্ষমতার মোহে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে না।
১৬. প্রতিনিধিত্ব : নিয়মতান্ত্রিক সরকারের অন্যতম উপাদান বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে জনগণের প্রতিনিধিত্বকে গণ্য করা যেতে পারে। এ সরকার ব্যবস্থায় জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে থাকে। আর আধুনিক গণতন্ত্রকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলা হয়ে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সাংবিধানিক সরকার নিয়মের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়। আর সংবিধান। হলো সকল নিয়মের দিকনির্দেশক। সাংবিধানিক সরকার প্রতিটি জাতির জন্যই কাম্য। কেবলমাত্র সাংবিধানিক সরকারের মাধ্যমেই নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা সম্ভব। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার না থাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।