সাংবিধানিক প্রথাসমূহ কেন মান্য করা হয় আলোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, প্রথাসমূহ মান্য করা হয় কেন? আলোচনা কর। অথবা, ব্রিটেনের প্রথাকে মান্য করা হয় কেন?
অথবা, ব্রিটেনের প্রথাগত বিধানসমূহের পিছনে কিসের অনুমোদন রয়েছে? বিস্তারিত লিখ।

উত্তরঃ ভূমিকা: সাংবিধানিক প্রথা ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসব প্রথাগুলো আইন নয় আধার এগুলো আদালত গ্রাহ্যও হয়। তা সত্ত্বেও এসব সাংবিধানিক রীতিনীতিকে কঠোরভাবে মান্য করা হয়। তবে কেন মান্য করা হয় এ প্রশ্নে ডাইসি বলেছেন, “সাংবিধানিক রীতিনীতি লঙ্ঘিত হলে দেশের আইন এবং আদালতের সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয়। তাই সাংবিধানিক রীতিনীতি মান্য করা হয়।” কিন্তু লাওয়েল (Lowell) বলেছেন, ‘পার্লামেন্ট সার্বভৌম” এটি প্রত্যেক বছর অধিবেশনে না বসারও ব্যবস্থা করতে পারে। তাঁর মতে, সাংবিধানিক রীতিনীতি ‘সম্মানের বিধিমালা’ হওয়ার জন্যই তা পালিত হয়।

প্রথাসমূহ কেন মান্য করা হয় মূলত ব্রিটেনে সাংবিধানিক রীতিনীতি আইনের সাথে সংঘর্ষের ভয়ে পালন করা হয় না। এর পিছনে কয়েকটি বাস্তবসম্মত কারণও রয়েছে। এগুলো নিচে আলোচনা করা হল:

১. জনমতের চাপ: ব্রিটেনে সাংবিধানিক প্রথাগুলো মেনে চলার মূল কারণ হল জনমতের চাপ। সাংবিধানিকরীতিনীতির প্রতি ব্রিটেনের জনগণের আনুগত্য প্রদর্শন এবং তাদের লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত সরকারকে
রীতিনীতি মান্য করতে বাধ্য করে। ব্রিটেনের জনগণ প্রত্যাশা করে যে, পার্লামেন্টের বার্ষিক অধিবেশন আহ্বত হবে এবং কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থা লাভে ব্যর্থ হলে পদত্যাগ করবে অথবা পুনর্নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।

জিংকে(Zink) বলেছেন, “এসব প্রত্যাশা পূরণ করা না হলে, যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে তাই এসব প্রত্যাশা পূরণের উত্তম গ্যারান্টি।”

২. বাস্তব উপযোগিতা: সাংবিধানিক প্রথা লঙ্ঘন ব্রিটেনে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতাকে ক্ষুন্ন করে। তাছাড়া
সাংবিধানিক রীতিনীতি সরকারকে সময়ের প্রয়োজনের সাথে খাপখাইয়ে নেয়। তাই এ বাস্তব উপযোগিতার উপলব্ধি রীতিনীতিগুলোকে মান্য করতে উদ্বুদ্ধ করে। ফ্রিম্যান বলেছেন, “সাংবিধানিক রীতিনীতির গুরুত্বকে যেহেতু অস্বীকার করা যায় না, তাই এগুলোকে মান্য করা হয়ে থাকে।”

৩. ইংরেজ জাতির রক্ষণশীলতা: ব্রিটিশরা প্রকৃতিগতভাবে রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন হওয়ায় স্বাভাবিক কারণে ও রীতিনীতিগুলোকে মান্য করার মধ্য দিয়ে তারা অতীতের গৌরবকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ অনুভব করে। ঐতিহ্যমণ্ডিত
রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের সাথে একাত্মতা স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলোকে গ্রহণ করায় সেগুলোর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে তারা দ্বিধাবোধ করে না।

৪. সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা: যুক্তরাজ্যের সনাতন ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে আইন অপেক্ষা শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো অনেক বেশি সক্ষম বলে মনে করা হয়। অতীতের সাথে বর্তমানের এবং বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতের যোগসূত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে রীতিনীতিগুলো অনবদ্য ভূমিকা পালন করে সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।

৫. শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা: শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষা করে তাকে সচল রাখে। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে কার্টার, রেনি ও হার্জ বলেছেন, “রীতিনীতিগুলোকে অমান্য করা হলে শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং সামগ্রিকভাবে সরকারি যন্ত্র অচল হয়ে যাবে।”

৬. আইনে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা: সাংবিধানিক রীতিনীতি অমান্য করা হলে তা আইনে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই এ সম্ভাবনা ও সাংবিধানিক রীতিনীতি মেনে চলতে বাধ্য করে। ১৯০৯ সালে লর্ডসভা সাংবিধানিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে কমন্সসভা কর্তৃক গৃহীত রাজস্ব বিলকে অগ্রাহ্য করে। আর এ কারণেই কমন্সসভা লর্ডসভার ক্ষমতা হ্রাসের জন্য ১৯১১ সালের ‘পার্লামেন্টারি অ্যাক্ট’ বিধিবদ্ধ করে।

৭. ক্যাবিনেটের অস্তিত্ব রক্ষা: ব্রিটেনে কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের নিয়ে ক্যাবিনেট গঠিত। ক্যাবিনেটের
পরামর্শক্রমে রাজা বা রাণী ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। কমন্সসভার আস্থা হারালে ক্যাবিনেটের পতন ঘটে, লর্ডসভার উপর
কমন্সসভার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব সাংবিধানিক প্রথাগুলো মান্য করা হয়, কারণ এসব প্রথা অমান্য করলে ব্রিটেনের
ক্যাবিনেট শাসনব্যবস্থার বুনিয়াদই ভেঙে পড়বে।

৮. রাজনৈতিক মনস্তাত্বিক কারণ: সাংবিধানিক রীতিনীতিগুলো অমান্য করলে আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করা যায় না বা অমান্যকারীর কোন শাস্তি হয় না বটে কিন্তু জনমনে বিরূপ প্রভাবের ভয়ে বা পরবর্তী নির্বাচনে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে সবাই এগুলো মেনে চলে।

৯. জনসম্মতি: গ্রেট ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় বহু ও বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত আছে। দেশবাসীর রাজনৈতিক জীবনধারার সাথে এগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ আইন এবং প্রথার মধ্যে পার্থক্যের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না এবং সাংবিধানিক রীতিনীতির প্রতি মানুষের নীরব সমর্থন রয়েছে।

১০. আইন লঙ্ঘনের ভয়। ডাইসি মনে করেন, প্রথা লঙ্ঘন করা মানে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘন করা। কারণ প্রথা অনুসারে ব্রিটেনে প্রতি বছর পার্লামেন্ট অধিবেশন বসে এবং রাজস্ব আদায় হয়। এ রাজস্ব নিয়েই তারা সামরিক বাজেট অনুমোদন করে। তাই প্রথা ভঙ্গ করলে এ সকল কাজ স্থগিত থাকবে এবং প্রশাসনিক জটিলতা বৃদ্ধি পাবে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ব্রিটেনের সাংবিধানিক এসব প্রথা মান্য করার ব্যাপারে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে। তাই আপামর জনগণ সরকারি দল, বিরোধী দল সবাই এগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এসব রীতিনীতিগুলো ব্রিটেনে প্রভুত্বকারী বুর্জোয়া শ্রেণীর অনুকূলে কাজ করছে এজন্য এগুলো নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠে না। তবে অবস্থায় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করলে যুক্তরাজ্যের শাসনতান্ত্রিক এসব প্রথাগুলোর প্রকৃতি ও পবিত্রতা নিয়ে যে কোন প্রশ্ন উঠবে না এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।