অথবা, সাংখ্য দর্শনে আত্মার স্বরূপ ব্যাখ্যা কর। আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণে সাংখ্যদের যুক্তিগুলো তুলে ধর।
অথবা, সাংখ্য দর্শন মতে পুরুষ এর স্বরূপ ব্যাখ্যা কর। পুরুষ এর অস্তিত্ব প্রমাণে সাংখ্যদের যুক্তিগুলো বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সাংখ্য দর্শন ভারতীয় দর্শনগুলোর মধ্যে প্রাচীন। সাংখ্য দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রবর্তক হলেন। মহর্ষি কপিল । সাংখ্য দর্শনের দুটি অর্থ আছে। যথা : প্রথমত, সম্যক জ্ঞান এবং দ্বিতীয়ত, সংখ্যাবোধক তত্ত্ব। সাংখ্য দর্শন হচ্ছে দ্বৈতবাদী দর্শন। কারণ সাংখ্য দার্শনিকগণের মতে, জগতের আদিকারণ বা আদিসত্তা হিসেবে দুটি সত্তা রয়েছে। যথা:
ক. প্রকৃতি ও খ. পুরুষ। প্রশ্নানুসারে নিম্নে পুরুষ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। তবে তার আগে প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
প্রকৃতির স্বরূপ : সাংখ্য দর্শন মতে, জগৎ ও জগতের প্রত্যেক বস্তু ও বিষয়ের মূল কারণ বা আদি উপাদান হলো অচেতন প্রকৃতি। এ প্রকৃতি অব্যক্ত। প্রকৃতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। প্রকৃতিকে জানতে হয় অনুমানের সাহায্যে। প্রকৃতির গুণগুলো সূক্ষ্ম বলে প্রত্যক্ষ করা যায় না। তাঁদের মতে, প্রকৃতি এক, বহু নয়। প্রকৃকি জড় এবং অসীম বা সর্বব্যাপী। প্রকৃতি নিত্য,
এর কোন জন্ম ও বিনাশ নেই। প্রকৃতি স্বনির্ভর, আদি এবং অনন্ত। জগৎ অব্যক্ত অবস্থায় অবস্থান করে এবং পরে এ প্রকৃতি হতে ক্রমে ক্রমে জগতের বিচিত্র অভিব্যক্তি বা বিবর্তন হয়। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রাক্কালে প্রকৃতির উপাদান এবং শক্তিসমূহের বিরূপ পরিণাম আরম্ভ হয়, একে অন্যকে প্রভাবিত করে। রজোগুণের (যাবতীয় দুঃখের কারণ হলো প্রকৃতির
রজোগুণ) দ্বারাই প্রকৃতির সাম্যাবস্থা প্রথমে ভাঙে। প্রকৃতির প্রত্যেকটি উপাদান, শক্তি এবং বৃত্তি একে অন্যের আপেক্ষিক, আকুতি অথবা প্রবণতাযুক্ত। সাংখ্য দর্শন মতে, জগৎ সৃষ্টির পূর্বে প্রকৃতি সত্ত্ব, রজঃ তমোগুণের সাম্যাবস্থায় থাকে। প্রকৃতির মধ্যে জগৎ অব্যক্ত থাকলেও প্রকৃতির সাম্যাবস্থার অবসান না ঘটলে জগতের অভিব্যক্তি সম্ভব নয়।
সাংখ্য মতে, পুরুষ বা আত্মার স্বরূপ : সাংখ্য দর্শনে আত্মাকে পুরুষ বলা হয়। পুরুষ হলো শাশ্বত চৈতন্যস্বরূপ, যা জাগতিক পরিবর্তন ও ক্রিয়ার সাক্ষী, কিন্তু নিজে অপরিণামী ও নিষ্ক্রিয়। সাংখ্য মতে, পুরুষের উৎপত্তি ও
বিনাশ নেই । পুরুষ জড় নয়, জড়ের প্রকাশক। পুরুষ নির্বিকার ও পরিবর্তন রহিত। পুরুষ সৃষ্টও নয়, স্রষ্টাও নয়। পুরুষ প্রকৃতিজাত দ্রব্যের স্রষ্টা। পুরুষ ভোক্তা, জ্ঞাতা এবং নির্গুণ। পুরুষ কর্তা নয়। পুরুষ স্বভাবত মুক্ত। পুরুষের বন্ধন স্বাভাবিক নয় অহংকারবশত পুরুষ যখন নিজেকে কর্তা মনে করে, তখন দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে তার অভিন্নত্ববোধ জন্মে এবং তখনই বন্ধনপ্রাপ্ত হয়। প্রকৃতির যাবতীয় কর্ম ও পরিবর্তনকে পুরুষ স্রষ্টারূপে দর্শন করে। পুরুষ জাগতিক বস্তুর ভোক্তা। টেবিল, চেয়ার প্রভৃতি বস্তু যেমন নিজেরা নিজেদের ভোগে লাগে না, অপরের ভোগের জন্য ব্যবহৃত হয়, তেমন প্রকৃতিজাত বস্তুকে প্রকৃতি ভোগ করে না, পুরুষই তা ভোগ করে। পুরুষ শুদ্ধ, মুক্ত এবং সুখ-দুঃখের অতীত। সাংখ্য মতে, পুরুষ এক নয়, বহু। দেহ ভেদে পুরুষ বিভিন্ন। তাঁদের মতে, পুরুষ বহু না হয়ে এক হলে সকলেরই একই রকম জ্ঞান হতো, একই সঙ্গে জন্ম বা মৃত্যু হতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।
পুরুষ বা আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ : সাংখ্য দার্শনিকগণ পুরুষ বা আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো উপস্থাপন করেছেন।
প্রথমত, সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, ঘট, পট, চেয়ার, টেবিল প্রভৃতি সংঘাত, অর্থাৎ সাবয়ব জড়দ্রব্য অপরের প্রয়োজন সাধন করে থাকে। এরা যার প্রয়োজন সাধন করে তা জড়দ্রব্য হতে পারে না। যেহেতু প্রত্যেক জড়দ্রব্য অপরের প্রয়োজন সাধন করে। সুতরাং
এমন কোন চেতন সত্তা আছে যার প্রয়োজন জড়দ্রব্যগুলো মিটিয়ে থাকে। সাংখ্য মতে, চেতন সত্তাই পুরুষ বা আত্মা।
দ্বিতীয়ত, সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, মন, বুদ্ধি প্রভৃতি যাবতীয় জড়দ্রব্য অচেতন। তাই তারা নিজেদের নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যেমন : একটি মোটরগাড়ি নিজে নিজে চলতে পারে না। তাকে চালানোর জন্য একজন চালক প্রয়োজন পড়ে। তেমনি যাবতীয় জড়বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোন চেতন নিয়ন্ত্রক প্রয়োজন, সেই চেতন বা নিয়ন্ত্রক
হলো পুরুষ বা আত্মা।
তৃতীয়ত, জগতের প্রত্যেক দ্রব্যই সুখাত্মক, দুঃখাত্মক ও বিষাদাত্মক। কিন্তু সুখ, দুঃখ ও বিষাদ অনুভূতির বস্তু। কোন জড় বা অচেতন দ্রব্য সুখ, দুঃখ ও বিষাদকে অনুভব করতে পারে না। সুতরাং সুখ, দুঃখ ও বিষাদকে ভোগ করার জন্য চেতন সত্তার অস্তিত্ব অনিবার্যভাবেই স্বীকার করতে হয়। এ চেতন সত্তাই হলো পুরুষ।
চতুর্থত, সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, দৃশ্য এবং দ্রষ্টা যে ভিন্ন এ কথা স্বীকার করতেই হবে। আর দৃশ্য থাকলে দৃশ্যের দ্রষ্টার অস্তিত্বও স্বীকার করতে হবে। জগৎ দৃশ্যমান। সুতরাং এ জগতের দ্রষ্টারূপী সচেতন ও ত্রিগুণাতীত নিত্য সত্তার অস্তিত্বও স্বীকার করতেই হবে। সে সত্তাই হলো পুরুষ বা আত্মা। সাংখ্য দার্শনিকগণ এভাবেই পুরুষের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন।
সমালোচনা : পুরুষের বহুত্ব প্রমাণের জন্য সাংখ্য দার্শনিকগণ যেসব যুক্তি দিয়েছেন তা নিম্নোক্তভাবে সমালোচিত হয়েছে। যথা :
প্রথমত, সাংখ্যরা বলেন, পুরুষ বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ। কিন্তু এটি যদি সত্য হয় তবে চৈতন্যের বিভাগও সম্ভব নয়। সুতরাং চৈতন্যস্বরূপ আত্মারও বিভাগ সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, সাংখ্য মতে, পুরুষ অনাদি নিত্য ও সর্বব্যাপী। কিন্তু বহু পুরুষদের অস্তিত্ব স্বীকার করলে পুরুষকে আর সর্বব্যাপী বলা চলে না। পুরুষ সীমিত হয়ে পড়ে। সুতরাং সাংখ্য দর্শনের বহু পুরুষবাদ অযৌক্তিক।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, জগৎ সৃষ্টির উপাদান কারণ হিসেবে সাংখ্য দার্শনিকগণ যে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন তা ভারতীয় দর্শনে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং জগৎ সৃষ্টির জন্য পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন বলে যে বক্তব্য প্রদান করেছে তার গুরুত্বকেও অস্বীকার করা যায় না। কাজেই পুরুষ বা আত্মার স্বরূপ সম্পর্কে সাংখ্য দার্শনিকগণ যে
যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন তা ভারতীয় দর্শনে বিশেষ একস্থান দখল করে আছে।