অথবা, সামাজিক বিবর্তনের পর্যায় হিসেবে শিকার ও সংগ্রহমূলক সমাজের বণ্টন ব্যবস্থা বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক বিবর্তনের পর্যায় হিসেবে শিকার ও সংগ্রহমূলক সমাজের বণ্টনব্যবস্থা পর্যালোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষের আজকের অবস্থান কোন আকস্মিক ঘটনার ফলশ্রুতি নয়। বর্তমানের শিল্পায়িত সমাজে পদার্পণ করতে মানুষকে বহু পথ পরিক্রমায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। শিকার ও সংগ্রহ সমাজে মানুষ পুরোমাত্রায়। যাযাবর জীবনযাপন করত। সংঘবদ্ধ দলে বিভক্ত হয়ে তারা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াত। হন্যে হয়ে দুর্গম পথ অতিক্রমের মধ্যদিয়ে তারা জীবিকানির্বাহ করত।
শিকার ও সংগ্রহ সমাজের বণ্টন ব্যবস্থা : শিকার ও সংগ্রহ সমাজের বণ্টন ব্যবস্থা সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
ক. অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত : শিকার ও সংগ্রহ সমাজে মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে নি। খাদ্যের যোগানেও ছিল না নিশ্চয়তা। ফলে সমাজে অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত ছিল না। Lenski বলেছেন, “কোন মানবগোষ্ঠীর উৎপাদনের সে অংশকে কেউ ইচ্ছা করলে নিজের একচেটিয়া অধিকারে নিতে চাইতে পারে, যে অংশ ঐ গোষ্ঠীর উৎপাদকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য তেমন প্রয়োজন নেই।” সমাজে উদ্বৃত্ত উৎপাদন না থাকায় উদ্বৃত্ত অর্থনীতি বিরাজ করে নি। তাই আর্থিক বস্তুর ক্ষেত্রে আপেক্ষিক অর্থে সমতা বিরাজ করছিল। সমাজের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতার বিষয় নিয়ে বিভিন্ন পর্যবেক্ষক গবেষণা করেছেন। কেউ কেউ সমতার নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
খ. গোষ্ঠী মালিকানা : শিকার ও সংগ্রহ সমাজে ব্যক্তিমালিকানার উপস্থিতি ছিল না। সেখানে সম্পত্তিতে যৌথ মালিকানা ছিল। মানুষ যা কিছু অর্জন করত সকলে মিলে সেটা ভোগ করত। Ford বলেছেন, “সবার সাথে মিলেমিশে ভাগ করে বা শেয়ার ভোগ করলে কোন ব্যক্তি কেবল সম্মানই অর্জন করে না, তার দানশীলতা তাকে নিরাপত্তা এনে দেয়।
কারণ তার কাছ থেকে যে দান গ্রহণ করে, সে আবার তার দাতার প্রয়োজনে নৈতিক কর্তব্যের টানে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। এ সমাজের মানুষ মানবীয় গুণাবলিতে সমৃদ্ধ ছিল।”
গ. বৃদ্ধদের অবস্থান : শিকার ও সংগ্রহ সমাজে বৃদ্ধরা কোন কাজ করতে না পারলেও কোন কোন গোষ্ঠীর মধ্যে তাদের প্রতি দুর্ব্যবহারের পরিবর্তে সম্মান ও শ্রদ্ধা পোষণ করা হতো। আন্দামান ও অস্ট্রেলিয়ান সমাজে বৃদ্ধদে
সম্মানজনক অবস্থান ছিল। এ সমাজে বৃদ্ধরা শাসনভার গ্রহণ করত । অন্যদিকে এস্কিমো ও ক্যালিফোর্নিয়ার সমাজব্যবস্থায় ছিল বিপরীত অবস্থা ।
ঘ. নেতার কর্তৃত্ব : শিকার ও সংগ্রহ সমাজে নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যারা নেতৃত্ব প্রদান করত, তারা সমাজে সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করত। Radcliff Brown তাঁর গবেষণায় দেখান, তিন ধরনের ব্যক্তি সমাজে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করত। তারা হলো :
বৃদ্ধ, অতিপ্রাকৃত শক্তি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ, বিশেষ গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তি | পরিচয় দিলে তাকে অপসারণ করা হতো। শিকারে পারদর্শী ব্যক্তিকে নেতার সমান মর্যাদা প্রদান করা হতো। অন্যদিকে, যারা শিকার করতে পারত না তারা না খেয়ে মৃত্যুবরণ করত। নেতৃত্ব প্রদানে কেউ ব্যর্থতার
ঙ. শামান : শিকার ও সংগ্রহ সমাজে শামানরা সম্মান ও মর্যাদা লাভ করত। তারা কখনও কখনও নেতার চেয়েও বেশি মর্যাদা লাভ করত। শামানদেরকে Headman নির্বাচন করতে দেখা যেত। শামানদের রোগী সুস্থ করার সংখ্যার ভিত্তিতে মর্যাদা প্রদান করা হতো। যে যত বেশি রোগীকে সুস্থ করতে পারত, সে তত বেশি মর্যাদা লাভ করত।
অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী শামানদের বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হতো। তারা মানুষের রোগের কারণ নির্ণয় করত।
চ. সামাজিক অসমতা : শিকার ও সংগ্রহ সমাজে স্বল্পমাত্রায় হলেও সামাজিক অসমতা বিরাজ করত। সমাজের Headman বা Chiefরা সম্মান, মর্যাদা ও বিশেষ সুযোগ সুবি
ধা ভোগ করত। এছাড়াও সমাজের ব্যক্তিরা দক্ষতা ও মেধার ভিত্তিতে সমাজে সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করত।
ছ. অর্জিত গুণ : শিকার ও সংগ্রহ সমাজে বংশসূত্র নির্ভর করে এমন কোন ভূমিকা ছিল না, যা প্রতিষ্ঠিত কোন অধিকার কোন সুনিশ্চিত করে। সীমিত সম্পদের এসব সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে তাই নিজ গুণে সবকিছু অর্জন করতে হতো। সমাজব্যবস্থা এখান থেকেই কঠোর হতে থাকে। সমাজ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধকে উৎসাহিত করে।
জ. শ্রেণী সমতা : শিকার ও সংগ্রহ সমাজে কোন সামাজিক শ্রেণী গড়ে উঠে নি। সমাজের সকলে মিলে একটি নির্দিষ্ট জীবনপ্রণালী নিয়ে বসবাস করত। এ সমাজে Headman, Shaman, সাধারণ মানুষ একই ধরনে জীবনযাপন করত।
ঝ. নারীর অবস্থান : শিকার ও সংগ্রহ সমাজে অবিবাহিত নারীর তুলনায় বিবাহিত নারী’ বেশি সম্মান লাভ করত। Headman বা Chief এর পরিবারের নারীরা বেশি সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করত। Chief এর স্ত্রীরা অস্ট্রিস পাখির ডিমের খোলা দিয়ে তৈরি মালা পরতে পারত। সাধারণ নারীরা সেটা পারত না। এছাড়াও তারা শিকার করা প্রাণীর চামড়া দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করত।
ঞ. লিঙ্গভিত্তিক বণ্টন : এ সমাজে লিঙ্গভিত্তিক সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থা ছিল। পুরুষ সর্বদা নারীর তুলনায় বেশি সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করত। পুরুষ শিকারে অংশগ্রহণ করত এবং তাদের দৈহিক শক্তি ছিল বেশি। নারী পুরুষের ন্যায় শিকারে অংশগ্রহণ করতে পারত না। ফলে তারা সমাজে নি মর্যাদা ভোগ করত।
ট. শিকার ও যুদ্ধ কৌশল : এ সমাজে যে ব্যক্তি শিকার ও যুদ্ধ কৌশলে পারদর্শিতা দেখাতে পারত, সে ব্যক্তি সমাজে বেশি মর্যাদা ও সম্মান ভোগ করত। বিপরীতভাবে যে ব্যক্তি শিকার ও যুদ্ধে পারদর্শিতা দেখাতে পারত না, সে ব্যক্তি কম সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করত।
ঠ. নারীর মর্যাদা : সমাজে পুরুষের তুলনায় নারীর সম্মান ও মর্যাদা কম থাকলেও নারীরা কখনও কখনও সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করত । Kurani নামক অস্ট্রেলিয়ার একটি ট্রাইবাল সমাজে নারী বয়স ও সামর্থ্য বিচারে বেশি সুবিধা ভোগ করত। পুরুষরা তাদের নিকট পরামর্শ গ্রহণের জন্য আসত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, শিকার ও সংগ্রহ সমাজে মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতি হয় নি। তারা যাযাবর জীবনযাপন করতে গিয়ে অধিকার সচেতন হয়ে উঠে নি। সমাজে যোগ্যদের সম্মান ও মর্যাদা থাকলেও কোন শ্রেণী গড়ে উঠে নি। মানুষ এ সময় থেকেই বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকে। পরবর্তী সমাজ।বিকাশে এ সমাজ মানুষের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করেছিল।