সমাজ জীবনে মূল্যবোধের ভূমিকা ব্যাখ্যা কর?

অথবা, মানবজীবনে মূল্যবোধ কী ভূমিকা পালন করে, তা আলোচনা কর।
অথবা, সমাজজীবনে শৃঙ্খলার জন্য মূল্যবোধের কোন অবদান আছে কী? থাকলে আলোচনা কর।
অথবা, মূল্যবোধ সমাজজীবনের জন্য কতটুকু প্রয়োজনীয়? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি সমাজব্যবস্থায় নিজস্ব বা স্বতন্ত্র সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেক সমাজ চায় ব্যক্তি সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হোক। ব্যক্তির কথায় কর্মে সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটুক। বস্তুত সমাজ এরূপ প্রত্যাশা করে কারণ কোন ব্যক্তি যদি সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুতি হয় তাহলে তা সমাজের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সমাজজীবনে মূল্যবোধের ভূমিকা : বিশ্বের প্রতিটি সমাজব্যবস্থায় স্বতন্ত্র আদর্শ ও মূল্যবোধ রয়েছে। এসব আদর্শ ও মূল্যবোধ গড়ে উঠে সমাজজীবনে দীর্ঘদিন একত্রে বসবাস করার মানবীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ধর্ম, দর্শন, বহু দিনের লালিত আচার বিশ্বাস ও স্থানীয় রেওয়াজ প্রথার আলোকে নির্মিত হয় কোন সমাজের নিজস্ব আদর্শ ও মূল্যবোধ। এভাবে প্রতিটি সমাজে গড়ে উঠে আচার আচরণের মান, আচরণের সমাজ স্বীকৃত পন্থা-পদ্ধতি, আচরণ মূল্যায়নের মাপকাঠি ও ভালোমন্দ, ঠিক বেঠিক, কাঙ্ক্ষিত অনাঙ্ক্ষিত বলে আখ্যা দেয়ার সমাজ স্বীকৃত ধারণা। সর্বোপরি সমাজ জীবনে আদর্শ ও মূল্যবোধের ভূমিকা অপরিসীম। নিম্নে সংক্ষেপে সমাজজীবনে আদর্শ ও মূল্যবোধের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. ব্যক্তির আচার আচরণ তথা চরিত্র গঠন : একথা সর্বজনস্বীকৃত যে সমাজস্থ ব্যক্তির আচার আচরণ তথা তার চরিত্র গঠনে তার নিজস্ব সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধ যথেষ্ট প্রভাব রাখে। বিভিন্ন পরিবেশে সে কিভাবে মিশবে, স্থান- কাল পাত্রভেদ অনুযায়ী কিভাবে আচরণ করবে- কাকে স্নেহ আর কাকে শ্রদ্ধা করবে, কাকে কিভাবে সমীহ করবে, কোন বিষয় কতটা ভক্তিভরে বা গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করবে তার অনেকটাই তার সমাজ থেকে অর্জিত আদর্শ ও মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে।
২. সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া : সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির মনোভাব ও ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, গোষ্ঠী ও শ্রেণীর প্রতি কি ধরনের মনোভাব পোষণ করবে তা নির্ভর করে ব্যক্তির মনোভাব ও ব্যক্তিত্বের ধরনের উপর। আর এ ব্যক্তিত্ব ও মনোভাব তৈরিতে সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে।
৩. পরিণত বয়সের ভূমিকা : পরিণত বয়সের ব্যক্তি তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে কি ভূমিকা রাখবে সেটাও অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত হয় শৈশব ও কৈশোরে সমাজ থেকে অর্জিত আদর্শ ও মূল্যবোধ দ্বারা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, কোন ব্যক্তি যদি বাল্য বা কৈশোরে বিশেষ কোন ধর্মীয় আদর্শ বা বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে তাহলে যৌবনে বা কর্মজীবনে তদানুযায়ী সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হবে।
৪. ঐক্য ও সংহতি রক্ষা : আদর্শ ও মূল্যবোধ সামাজিক ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করে। কেননা সমাজবদ্ধ মানুষ তাদের নিজ নিজ আদর্শ ও মূল্যবোধের শিক্ষানুযায়ী সমাজে ঐক্যবদ্ধভাবে সংহতি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করে বসবাস করে।
৫. সমাজের চালিকাশক্তি : আদর্শ ও মূল্যবোধ হলো সমাজের চালিকাশক্তি। ব্যক্তি যেমন তার সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয় সমাজও তার লক্ষ্য অর্জনে আদর্শ ও মূল্যবোধকে কাজে লাগায়- সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করে ও ব্যক্তি আচরণকে কাঙ্ক্ষিত পথে নিয়ন্ত্রণ ও সংশোধন করে। আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হলে ব্যক্তির মধ্যে আদর্শহীনতা দ েখা দিবে এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় সূচিত হবে। এ অবস্থায় ব্যক্তি তার চিন্তাভাবনা এবং কাজকর্মে আদর্শিক পথনির্দেশনা হারিয়ে ফেলে। বস্তুত এ ধরনের পরিস্থিতিতে ব্যক্তির মধ্যে বিচ্যুতি দেখা দেয় যা তাকে কখনো বা অপরাধপ্রবণ করে তুলতে পারে। এ অবস্থায় সমাজের বিপর্যয় ঘটে। আদর্শিক এবং মূল্যবোধগত বিপর্যয় ঘটলে সমাজে অস্থিরতা দেখা দেয়। কেননা এ অবস্থায় ব্যক্তি তার উপর সমাজ কর্তৃক কাঙ্ক্ষিত আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজ তথা সংস্কৃতি কর্তৃক কাঙ্ক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত আচরণ বোধই হলো আদর্শ। আর ভালো বা মন্দ, কাঙ্ক্ষিত বা অনাঙ্ক্ষিত এবং ঠিক বা বেঠিক সম্পর্কে সমাজে বিদ্যমান ধারণার নামই মূল্যবোধ। মূলত সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অপরাধ এবং সামাজিক অস্থিরতার মূলে রয়েছে আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে আসা। তাই সমাজজীবনে এ আদর্শ ও মূল্যবোধের ভূমিকা অপরিসীম।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%95%e0%a7%83%e0%a6%a4-%e0%a6%ac/