সমাজসংস্কার হিসেবে আল-গাজালির অবদান সংক্ষেপে লিখ।

অথবা, আল-গাজালির অবদান সংক্ষেপে লিখ।
অথবা, সমাজ সংস্কারে আল-গাজালির অবদান কি?
অথবা, আল-গাজালির অবদান সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম জাহানের এক যুগসন্ধিক্ষণে বিভিন্ন অভিনব মতবাদের টানাপড়েনে যখন মুসলিম জাহান ভিতর ও বাইরে উভয়দিক থেকে এক সংকট অবস্থার সম্মুখীন, তখন ইসলামি জগতের শ্রেষ্ঠ মৌলিক চিন্তাবিদ ইমাম আল-গাজালির (৪৫০ হিজরি/১০৫৮ খ্রি. – ৫০৫হি./১১১১খ্রি.) আবির্ভাব ঘটে। আল-
গাজালির পুরো নাম আবু হামিদ মুহাম্মদ আল-গাজালি। মুসলিম, ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাধারার ইতিহাসে আল-গাজালি এক অনন্য স্থান দখল করে আছেন।
সংস্কারক হিসেবে আল-গাজালি : আল-গাজালি ঈমানের সংস্কারক। তিনি ইসলাম ধর্মের সংস্কার করেছেন। তাঁর চিন্তাধারাকে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের উচ্চতম বিবর্তন বলে বিচার করা হয়। তিনি ধর্মের সমালোচনার চেয়ে সংস্কার সাধনই বেশি করেছেন। তাঁর যুগে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক শৈথিল্য দেখা দিয়েছিল। কেউ কেউ শুধু ধর্মের বাহ্য রীতিনীতি মেনে তা রক্ষা করার চেষ্টা করত, দার্শনিকগণ নিজের পথে চলতেন এবং সুফিরা সাধারণ জীবনস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে আত্মিক উন্নতিতে মশগুল থাকত। তিনি আধুনিক ইউরোপিয়ান দার্শনিক ডেকার্ট এর মত.তার দার্শনিক আলোচনা শুরু করেন এক প্রারম্ভিক সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত তিনি সার্বিক সংশয় হতে মুক্তি লাভ করেন এবং সজ্ঞাপ্রসূত জ্ঞান বা মরমি অভিজ্ঞতায় পরমসত্য সত্তার জ্ঞান লাভে সমর্থ হন। পরমতত্ত্ব ও সত্যের সন্ধান লাভের আগে তিনি তদানীন্তন সত্যানুসন্ধানকারীদের চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। যথা :
১. স্কলাস্টিক ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়,
২. সুফি সম্প্রদায়,
৩. তালিমিয়া সম্প্রদায় ও
৪. দার্শনিক সম্প্রদায়।
১. স্কলাস্টিক ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায় : স্কলাস্টিক ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায় বলতে আল-গাজালি আশারিয়া সম্প্রদায়কে বুঝিয়েছেন। এ সম্প্রদায়ের প্রতি তার সমালোচনা লঘু প্রকৃতির ছিল। আশারিয়ারা ধর্মীয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতাকেই সমর্থন করেছেন এবং তারা মূলত স্কলাস্টিক পদ্ধতির দ্বারা মুতাজিলাদের যুক্তিসমূহ খণ্ডন করলেও সত্যানুসন্ধানের ক্ষেত্রে নিজস্ব কোন মৌলিক যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন নি। আল-গাজালি কেবল ধর্মতত্ত্ববিদদের স্কলাস্টিক পদ্ধতি সম্পর্কেই.বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন, কেননা এ পদ্ধতি কোন তাত্ত্বিক নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
২. সুফি সম্প্রদায় : আল-গাজালির সুফি সম্প্রদায়ের প্রতি তেমন কোন আপত্তি নেই। তিনি কেবল কিছু প্রমত্ত সুফির অসংযত সর্বেশ্বরবাদী বা সর্বখোদাবাদী উক্তি বা অসঙ্গতিপূর্ণ প্রবণতার বিরুদ্ধে আপত্তি প্রকাশ করেন। তিনি বিভিন্ন সুফিদের গ্রন্থাবলি অধ্যয়নের মাধ্যমে বুঝতে পারেন যে, সুফিতত্ত্বের সত্য উপলব্ধি করার সবচেয়ে বেশি নিশ্চিত পথ হচ্ছে তন্ময়তা এবং সুফিতত্ত্ব বুদ্ধিপ্রসূত জ্ঞানের চেয়ে সজ্ঞাপ্রসূত জ্ঞানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
৩. তালিমিয়া সম্প্রদায় : তালিমিয়া সম্প্রদায়ের মূলনীতি হলো পরমতত্ত্ব বা সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য অভ্রান্ত ইমামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন অপরিহার্য। তিনি এ মতাবাদকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন নি। কারণ এ সম্প্রদায়ের মূলনীতি কিছু মামুলি সূত্র ও প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠান ছাড়া কিছুই নয় এবং তারা অভ্রান্ত ইমামের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও সে ইমাম সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেন নি।
৪. দার্শনিক সম্প্রদায় : আল-গাজালি সে সময়ের সত্য অনুসন্ধানকারীদের মধ্যে দার্শনিক সম্প্রদায়ের মতামত দ্বারা সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হলেও তাদের মতামত তাকে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলেছে। তিনি মনে করেন, দার্শনিকেরা প্রত্যেকটা জিনিসকে যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করলেও শুধুমাত্র বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা দিয়ে যে পরমসত্তার জ্ঞান সম্ভব না এটা দার্শনিকেরা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ইমলামি চিন্তার জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে মৌলিক চিন্তাবিদ আল-গাজালি মুসলিম ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চিন্তার বিকাশে যে ব্যাপক সংস্কার করেছেন তা নিঃসন্দেহে অমূল্য ও অসাধারণ । তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও ব্যাপকতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে আল-সুরকী তাঁকে হযরত মুহম্মদ (স) এর পর সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষীরূপে গণ্য
করেছেন।