Download Our App

সমাজসংস্কারক হিসেবে ইমাম আল গাজালির অবদান আলোচনা কর।

অথবা, সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বে আল গাজালির সংস্কার ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সমাজ সংস্কারের ইমাম আল-গাজালির অবদান মূল্যায়ন কর।
অথবা, সমাজ সংস্কারের ইমাম আল-গাজালির অবদান ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বে আল-গাজালি কী কী সংস্কার সাধন করেন?
উত্তর৷ ভূমিকা :
ইসলামি জগতের শ্রেষ্ঠ মৌলিক চিন্তাবিদ ছিলেন ইমাম আল গাজালি (১০৫৮ খ্রি:- ১১১১খ্রি:) মুসলিম জাহানের ভিতরে ও বাইরে যখন খুব খারাপ অবস্থা বিরাজ করেছিল ঠিক তখনই ইমাম আল গাজালির আবির্ভাব ঘটে। দার্শনিক ধর্মীয় ও মুসলিম চিন্তার বিকাশে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদেরে যুক্তির সমালোচনা করে মুসলিম দর্শনে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তাই সমাজসংস্কারক হিসেবে তার অবদান অনস্বীকার্য।
আল গাজালির জন্ম ও কর্মজীবন : ইমাম আল গাজালি ১০৫৮ সালে ইরানের খোরাসান নামক প্রদেশের অন্তৰ্গত নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম হচ্ছে আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে তাউস আহম্মদ
আল তুসী আল শাফী আল নিশাপুরী। তিনি শৈশবেই তাঁর পিতাকে হারান। তাঁর পিতা ছিলেন একজন ধার্মিক দরবেশ। অনেকের ধারণা তাঁর জন্মপল্লী গাজ্জাল এর নামানুসারেই তিনি গাজালি উপাধি ধারণ করেন। ‘কিমিয়ায়ে সাদাত’, ‘ইয়াহ্ই য়া-উল-উলুম আদদীন’, ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’, ‘আল-মুনকিদ মিল–আল’ প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।
সমাজসংস্কারক হিসেবে আল গাজালির অবদান : মুসলিম চিন্তাজগতের একজন শ্রেষ্ঠ মনীষী ছিলেন ইমাম আল গাজালি। তিনি পাশ্চাত্য এমন কি সারা মুসলিম বিশ্বে একজন শ্রেষ্ঠ মুসলিম চিন্তাবিদ। তিনি ইসলাম ধর্মের
সমালোচনার চেয়ে সংস্কার সাধনই বেশি করেছেন। তিনি মুসলিম চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে মুসলিম জাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দান করেছেন। নিম্নে আল গাজালির সমাজসংস্কারকমূলক অবদান আলোচনা করা হলো :
১. নিষ্প্রাণ যুক্তিবাদিতার বিরোধিতা : বিভিন্ন দর্শনিক ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন যুক্তি প্রদর্শন করেন। কিন্তু আল গাজালি এসব নিষ্প্রাণ যুক্তির বিরোধিতা করেন। তিনি সাধারণ ও ধার্মিক লোকদেরকে কুরআন ও হাদিসভিত্তিক আলোচনায় ফিরিয়ে আনেন। মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা অপসারণের সময় সমগ্র ইউরোপে যা ঘটেছিল আল গাজালির নেতৃত্বে ইসলামে ঠিক অনুরূপ ঘটনাই ঘটেছিল। সুতরাং আল গাজালি ছিলেন ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তাবিদ এবং তার উদ্দেশ্য ছিল কুরআন ও হাদিসের আলোকে ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ের বিকাশ সাধন করা।
২. সামাজিক অনাচার রোধ : তৎকালীন সময়ে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে সামাজিক অনাচার ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃত সুফিদের ধর্মীয় চিন্তাধারা ও সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে অনেক অসাধু বা ভণ্ড সুফির উদ্ভব ঘটে। এসব অসাধু বা ভণ্ড সুফিগণ নিজেদের আধ্যাত্মিক ও মরমি অভিজ্ঞতাবাদী দাবি করলেও আসলে তারা এসবের কিছুই ছিল না। তারা শরিয়তকে বিভিন্নভাবে অপমানিত করতো। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তাই ইমাম আল গাজালি এসব সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ করে মুসলমানদের মধ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে আনেন।
৩. শরিয়তের অবহেলা রোধ : কিছু কিছু সুফি আছে যারা শরিয়তকে মানতে রাজী নয়। তারা শরিয়তকে অবহেলা করে। কিন্তু আল গাজালি বলেন, শরিয়তকে কোন মুসলমানেরই অবহেলা করা উচিত নয়। কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত.সকলের জন্য ফরজ। শরিয়ত সবার প্রতি সমানভাবে প্রযোজ্য থাকে। তার এ সমস্ত কার্যকলাপের জন্য অসাধু সুফিরা সতর্ক হতে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, সুফি এবং সাধারণ মুসলমানদের অবশ্যই শরিয়ত পালন করবে। তিনি আবারও বলেন, সুফি শিক্ষার নামে খানকায়ে কেউ নাচ, গান, আনন্দ, স্ফুর্তি করতে পারবে না। তিনি সে সময় মুসলমান সমাজকে সচেতন করে তোলেন। তাই তিনি তৎকালীন মুসলিম সমাজ কে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সংস্কার ও সার্থক করে তোলেন।
৪. সুফিবাদ সম্পর্কে সংশয়ের অবসান : সুফিরা ছিল মরমীভাবাপন্ন। তারা আধ্যাত্মিক রহস্য সম্পর্কে জানার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তারা খোদার প্রেমে বলিয়ান হয়ে জাত ও সিফাতের সাথে একাত্মতা পোষণ করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। ইমাম আল গাজালির প্রভাবেই সুফিবাদ ইসলামে শক্তিশালী আসন লাভ করেছে। তারা শরিয়তপন্থিদের অসতর্কর্তার কারণে সুফিবাদকে সংশয়ের চোখে দেখতেন। তিনি বলেছেন, ইসলাম ও সুফিবাদ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এভাবেই আল গাজালি সুফিবাদ সম্পর্কে সংশয়ের অবসান ঘটান।
মন্তব্য : ইমাম আল গাজালি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। তিনি ইসলামি ভাবধারায় এক নব দিগন্তের সূচনা করেছেন।.ইসলামি চিন্তাধারার এ নবজাগরণের প্রেক্ষিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু মনীষী ইমাম আল গাজালির অবদানকে দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি শুধু সুফিবাদ কিংবা দার্শনিক মতবাদই সংস্কার করেন নি, তিনি এর মাধ্যমে সমাজ চিন্তার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। তিনি এসব সংস্কারের মাধ্যমে গোঁড়াপন্থি ও উদারপন্থিদের সহাবস্থানের পথকে সুগম করেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ইমাম আল গাজালি মুসলিম জাতিকে সঠিক পথ নির্দেশনা দান করেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সংস্কারমূলক চিন্তানায়ক। তার নেতৃত্বে ইসলামে সংস্কারের ফলে একটি বাস্তবভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গঠিত হয়। তার এ সংস্কারমূলক চিন্তাধারা সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।