সমাজবিজ্ঞানের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক কী আলোচনা কর।

অথবা, সমাজবিজ্ঞানের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞান কতটা সম্পৃক্ত আলোচনা কর।
অথবা, সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যৌক্তিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ প্রথম থেকেই সমাজকে জানতে চেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৩৯ সালে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোঁৎ সর্বপ্রথম সমাজ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করেন এবং সমাজবিজ্ঞানের জন্ম দেন।
সমাজবিজ্ঞানের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক : সমাজবিজ্ঞানের দুটি শাখা হিসেবে সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক বেশ নিবিড়। সমাজবিজ্ঞান মূলত একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিজ্ঞানই বটে। সমাজবিজ্ঞান যেমন সমাজের সামগ্রিক বিষয় আলোচনা করে তেমনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল বিষয় হলো রাষ্ট্র এবং এর উৎপত্তি ও সংগঠন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে ব্যাপৃত। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক নির্ধারণ করে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি, গঠন, প্রকৃতি, ব্যক্তি ও সরকারের সম্পর্ক, নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য, সরকারের বিভিন্ন বিভাগ এগুলোর সাথে নাগরিকের সম্পর্ক প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্যবিষয়। অতীতে সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে কোন পার্থক্য নির্দেশ করা হতো না। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্র ও সমাজের কার্যপরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় উভয়ের পার্থক্য নির্দেশ করা হয়। তবে কিছু কিছু বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে অভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু মৌলিকভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের রাজনৈতিক জীবন আর সমাজবিজ্ঞান মানুষের সমাজজীবন নিয়ে ব্যাপৃত । সমাজবিজ্ঞানী Giddings সমাজবিজ্ঞান এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করতে গিয়ে লিখেছেন, সমাজবিজ্ঞানের সাধারণ জ্ঞান নেই এমন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের তত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষাদানের কাজটি এমন, যা নিউটনের গতিসূত্র সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিকে জ্যোতির্বিদ্যা শেখানো কাজের শামিল। দার্শনিক পল বলেছেন, “Political Science is that part of social science which treats of foundation of the state and principles of Government”.
সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক নিম্নে আলোচনা করা হলো :
ক. উভয়ের আলোচ্যবিষয় এক : সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান উভয়ই সামাজিক বিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞানের আলোচ্যবিষয় হচ্ছে মানুষ ও সমাজ। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্যবিষয় হচ্ছে সমাজের মানুষ ও তাদের রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, উভয়ের আলোচ্যবিষয় এক।
খ. উপাদান ও উপকরণ : সমাজবিজ্ঞান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভিন্ন উপাদান ও উপকরণ সংগ্রহ করে। তেমনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানও সমাজবিজ্ঞানকে বিভিন্ন উপাদান যোগান দেয়। অধ্যাপক ক্যাটালিনের মতে, “সমাজবিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চিন্তা অসম্ভব।”
গ. পরস্পর নির্ভরশীল : জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং উভয়েই আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। সমাজবিজ্ঞানের মূলভিত্তি হচ্ছে মানুষ ও সমাজ আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূলভিত্তি হচ্ছে রাষ্ট্র, মানুষ ও তাদের কার্যাবলি। মানুষ ছাড়া যেমন রাষ্ট্র গঠিত হয় না তেমনি সমাজ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। অতএব সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান উভয়ে উভয়ের উপর নির্ভরশীল।
ঘ. পরস্পর সম্পূরক : রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান পরস্পর একে অপরের সম্পূরক। সাধারণ সমাজকাঠামোর অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, সংগঠন ও কার্যাবলি সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞান আলোচনা করে। অধ্যাপক গেটেল বলেছেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এটা ধরে নেয়া হয় যে, ‘মানুষ রাজনৈতিক জীব’। কিন্তু মানুষ কিভাবে এবং কেন রাজনৈতিক জীব তা সমাজবিজ্ঞান ব্যাখ্যা দান করে।” একটি দেশের সামাজিক কাঠামো, পরি বেশ, সমাজবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিক গঠন প্রভৃতি বিষয়ের দ্বারা দেশের সরকারি কাঠামো ও সমাজ প্রভাবিত হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকেও উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান। সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান একে অন্যের গবেষণাগত জ্ঞান কাজে লাগাতে পারে। যেমন- সমাজকাঠামো সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীর জ্ঞান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে ক্ষমতার কাঠামো বিশ্লেষণে সাহায্য করতে পারে। একইভাবে ক্ষমতার কাঠামো সম্পর্কিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর জ্ঞান সমাজকাঠামো এবং সামাজিক স্তরবিন্যাস পাঠে সমাজবিজ্ঞানী সাহায্য করতে পারে। এভাবে একে অন্যের উপর নির্ভরশীল ও সম্পর্কযুক্ত।