সমাজবিজ্ঞানী এ. আর. দেশাই এর দৃষ্টিতে আধুনিকীকরণের তত্ত্বটি আলোচনা কর।

অথবা, আধুনিকীকরণ তত্ত্ব বলতে কী বুঝ? আধুনিকীকরণ সম্পর্কে এ. আর. দেশাই এর মতামতটি পর্যালোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সমাজবিজ্ঞানের মূলধারা অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞানের জন্মলগ্ন থেকে যে চিন্তাচেতনা দ্বারা সবচেয়ে বেশি কৃষ্টি হয়েছৈ আধুনিকীকরণ তত্ত্ব সেই চিন্তাধারাকে গ্রহণ করেছে এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছে। সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোঁৎ থেকে শুরু করে আধিকাংশ সমাজতাত্ত্বিক (কার্ল মার্কস, ম্যাক্স ওয়েবার, এমিল ডুরখেইম) এ তত্ত্বকে পরোক্ষভাবে আলোচনা করেছেন। তবে এসবের সমন্বয় সাধন করেছে সমসাময়িক সমাজতাত্ত্বিক ট্যালকট পরসন্স, ডব্লিউ ডব্লিউ রস্টো, নিল স্পেনসার, জেমস কেলম্যান প্রমুখ। তবে ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক এ. আর. দেশাই একটু ভিন্নভাবে এ তত্ত্বটি উপস্থাপন করেছেন।
এ. আর. দেশাইয়ের দৃষ্টিতে আধুনিকীকরণ তত্ত্ব (Modernization theory in the view of A. R. Dashi) : আধুনিকীকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বহু তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। এ. আর. দেশাই (A. R. Desai)
আধুনিকীকরণের তত্ত্বসমূহকে প্রধান পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন । যথা :

  1. The ideal typical index approach,
  2. The diffusionist approach,
  3. The psychological approach,
  4. The historical approach of radical social scientists,
  5. The Marxist approach.
    প্রথম তিনটি দৃষ্টিভঙ্গিকে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানিগণ সমর্থন করেন। ৫০ এর দশক থেকে আধুনিকীকরণ তত্ত্ব বিকাশলাভ করলেও ৭০ এর দশকের প্রথম পর্যন্ত উন্নত দেশসমূহ অনুন্নত দেশসমূহকে আধুনিকীকরণের পরিধি হিসেবে গ্রহণ করে।
    প্রথম তিনটি দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করে বিপ্লবী সমাজবিজ্ঞানীরা চতুর্থ দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটান। প্রথম চারটি দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশলাভ করেছে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুন্নত সমাজের
    আধুনিকীকরণ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এসব দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
    ১. আদর্শিক ধরনগত দৃষ্টিভঙ্গি (The ideal typical approach) : এ দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে উন্নত এবং অনুন্নত সমাজের পার্থক্য নির্ধারণ করা হয়। এখানে উন্নয়নকে কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করা হয়। Manning
    Nash, “The first mode is the index method the general feature of a developed economy are abstracted as and ideal type and then constructed with the equally ideal typical features of a poor economy and society. In this mode, development is viewed as the transformation of one type into another.” an দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকরা উন্নত দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দু’ধরনের মন্তব্য করেন। একপক্ষ আশাবাদী এবং অন্যপক্ষ
    নৈরাশ্যবাদী।
    ২. ব্যাপ্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (The diffusionist approach) : দ্বিতীয় প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি হলো Diffusionist approach.
    M. Nash তাঁর ‘Diffusionist approach’ এ বলেছেন, সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ উন্নত দেশ থেকে অনুন্নত দেশে অনুপ্রবেশ (The diffusion of cultural elements from the developed to the under developed countries.)
    এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয় অনুন্নত দেশসমূহ জ্ঞান, দক্ষতা, সংস্থা, মূল্যবোধ, কৃৎকৌশল, পুঁজি প্রভৃতির অভাবের মধ্যে থাকে। ফলে তারা অনুন্নত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে না। তাঁরা বিভিন্ন তাত্ত্বিক অনুপ্রবেশ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। অনুপ্রবেশের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি সম্পর্কেও তাঁরা আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উপাদানসমূহকে চিহ্নিত করা হয়।
    ৩: মনস্তাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি (The psychological approach) : Maclelland, Kunkel, Hagen প্রমুখ এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয় অনুন্নত দেশের লোকদের আচরণে পরিবর্তন আনয়নের মাধ্যমে সেসব
    দেশের উন্নয়ন সম্ভব। তাঁরা অনুন্নত দেশের মানুষকে পরিশ্রমী হওয়ার কথা বলেছেন।
    ৪. মৌলিক সমাজবৈজ্ঞানিকদের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি (The historical approach of radical social scientists) : এ দৃষ্টিভঙ্গিতে উন্নত এবং অনুন্নত দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পার্থক্য করা হয়। এখানে বলা
    হয়, তথাকথিত উন্নত এবং অনুন্নত দেশের মধ্যকার সম্পর্ক কোন ইতিবাচক দিকের উন্মোচন করতে পারে না। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে
    আরো বলা হয় দেশগুলো নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বসংঘাত সৃষ্টি করে, যার মধ্য দিয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে পারে।
    ৫. মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি (The Marxist approach) : এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয়, পৃথিবীতে অনুন্নত দেশসমূহকে অনুন্নত রাখা হয় এবং সামান্য কিছু দেশ উন্নতি লাভ করে। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয় বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ার বিকাশ আলোচনার মাধ্যমে অনুন্নয়নের কারণ সম্পর্কে জানা সম্ভব।
    উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, আধুনিক একটি প্রক্রিয়া। আর এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ববর্তী আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক মূল্যবোধের স্থলে নতুন ভাবধারার উদ্ভব ঘটে। একথা স্পষ্ট যে, বিশ্বে মেরুকরণের প্রচেষ্টা স্পষ্ট। এক বিশ্ব শাসন করছে, অন্য বিশ্ব শোষিত হচ্ছে। আধুনিকীকরণ তত্ত্ব অনুন্নয়নের কারণ অনুসন্ধান করে এবং অনুন্নয়ন থেকে উত্তরণের কথা বলে । আধুনিকীকরণ তত্ত্বের সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে বিশ্বের অনেক অনুন্নত দেশের উন্নয়ন সম্ভব।