অথবা, সমাজকাঠামো বলতে কী বুঝায়?
অথবা, সমাজকাঠামো কী?
অথবা, সমাজকাঠামো কাকে বলে?
উত্তরা৷ ভূমিকা : সমাজ বিকাশের আলোচ্যবিষয় হলো সমাজ কাঠামো। যে কোন সমাজকে জানার জন্য সে সমাজের সমাজ কাঠামো জানার বিকল্প নেই। শুধু সমাজ কাঠামোর মাধ্যমেই সমাজকে অনুধাবন করা যায়। সমাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটে কতকগুলো বিষয় দ্বারা। সে বিষয়গুলোই হলো সমাজ কাঠামোর উপাদান। তাই সমাজ কাঠামোর বিশ্লেষণ পরিপূর্ণ হয় এর উপাদানসমূহের বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
সমাজ কাঠামো (Social structure) : সমাজ কাঠামো হলো সমাজস্থ ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে একটা পারস্পরিক সম্পর্কের জালস্বরূপ, যেখানে সবাই নিজস্ব ভূমিকা পালনের মাধ্যমে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। এককথায় প্রতিটি সংগঠনই একটি ‘Action structure’ বা কার্ষিক সংস্থা; এর সাথে একটি গোষ্ঠী জড়িত এবং এর সদস্যরা প্রত্যেকে
প্রত্যেকের সাথে কর্মসূত্রে আবদ্ধ।
শাব্দিক অর্থে : Structure শব্দটি শুরুতে প্রকৌশলীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে উনিশ শতকের মধ্যভাগে জ্ঞানবিজ্ঞানের যুগান্তর আনয়নকারী Charles Darwin তাঁর The Origin of Species’ and ‘The Descent of Man’ গ্রন্থে জীবের বিবর্তনের এ প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। প্রায় তখন থেকেই Darwin দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে Social Darwin হিসেবে খ্যাত Herbert Spencer সমাজপাঠে, সমাজ কাঠামোকে জানার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। তিনি সমাজের পঠন, তার ‘Functional system and their change পর্কে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা শুরু করেন। পরব Durkheim তাঁর ‘The Division of Labour in Society’ এবং Radcliffe Brown তাঁর ‘On Social Structure’ গ্রন্থে Social structure কে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেয়ার চেষ্টা করেন। তাদেরই মৌল প্রয়াসে সমাজ কাঠামো প্রত্যয়টি সমাজবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হিসেবে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা পায়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী সমাজ কাঠামো সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো : রেডক্লিফ ব্রাউন (Radcliffe Brown) বলেন, “ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সব ধরনের সামাজিক সম্পর্ক হলো সমাজ কাঠামো।” মরিস জিন্সবার্গ (M. Ginsberg) সামাজিক সম্পর্ক এবং গোষ্ঠীর উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “সমাজ কাঠামো হলো প্রধান প্রধান গোষ্ঠী এবং অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের এক জটিল রূপ, যার দ্বারা সমাজ গঠিত হয়।” ই. আর. লিচ (E. R. Leach) মতে, “ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের যে সমষ্টিগত ধারণা, তার সমন্বয়ে সমাজ কাঠামো গঠিত। মূলত এখানে তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের কোন কথা বলেন নি।”
গার্থ এবং মিলস (H. Gerth and C. W. Mills) তাঁদের ‘Character and Social Structure’ গ্রন্থে বলেন, “ভূমিকার মাধ্যমে আমরা যে কোন প্রতিষ্ঠানের ধারণা পেতে পারি, তেমনি প্রতিষ্ঠান একটি উপাদান, যার ভূমিকার মাধ্যমে সমাজ কাঠামো সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।” এস. এফ. নেডেল (S. F. Nadel) তাঁর ‘The Theory of Social Structure’ গ্রন্থে বলেন, “ব্যক্তির নির্দিষ্ট ভূমিকার মাধ্যমে সমাজ কাঠামো উপলব্ধি করা যায়।” কার্ল মার্কস (K. Marx) সমাজ কাঠামো বলতে এর দুটি অংশকে বুঝিয়েছেন। যেমন- ক. মৌল কাঠামো (Basic structure) খ. উপরি কাঠামো (Super structure)। মার্কসীয় ব্যাখ্যায় সমাজ কাঠামোর উৎপাদন সম্পর্কের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সামাজিক শ্রেণি বা গোষ্ঠীর প্রাধান্য নিরূপণ করা হয়ে থাকে। মূলত অর্থনৈতিক উৎপাদন সম্পর্ক দ্বারা সমাজের বস্তুগত বা অর্থনৈতিক কাঠামো বা উৎপাদন শক্তির যে বিকাশ ঘটে তা সমাজের মৌল কাঠামো তৈরি করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সমাজ কাঠামো হলো সমাজস্থ ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে একটা পারস্পরিক সম্পর্কের জালস্বরূপ, যেখানে সবাই নিজস্ব ভূমিকা পালনের মাধ্যমে মিথষ্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। এ সামাজিক সম্পর্কই সমাজ কাঠামোকে গড়ে তোলে।