সমাজকাঠামোর উপাদান সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, উপাদানের আলোকে সমাজকাঠামো আলোচনা কর।
অথবা, সমাজকাঠামো গড়ে উঠার পিছনে কী কী উপাদান মুখ্য ভূমিকা
পালন করে?
উত্তর৷ ভূমিকা :
সমাজ বিকাশের আলোচ্যবিষয় হলো সমাজ কাঠামো। যে কোন সমাজকে জানার জন্য সে সমাজের সমাজ কাঠামো জানার বিকল্প নেই। শুধু সমাজ কাঠামোর মাধ্যমেই সমাজকে অনুধাবন করা যায়। সমাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটে কতকগুলো বিষয় দ্বারা। সে বিষয়গুলোই হলো সমাজ কাঠামোর উপাদান। তাই সমাজ কাঠামোর বিশ্লেষণ পরিপূর্ণ হয় এর উপাদানসমূহের বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
সমাজ কাঠামোর উপাদান : যেসব বিষয়াবলি ও উপকরণের সমন্বয়ে সমাজ কাঠামো প্রক্রিয়া আবর্তিত হয় তাকেই সমাজ কাঠামোর উপাদান বলে । সমাজবিজ্ঞানী মরিস জিন্সবার্গ সমাজ কাঠামোর উপাদান হিসেবে সমাজের প্রধান প্রধান অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান এবং দলকে চিহ্নিত করেছেন। নিম্নে সমাজ কাঠামোর উল্লেখযোগ্য উপাদানসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. সমাজস্থ মানুষ ও তাদের ভূমিকা : সমাজবদ্ধ মানুষ ছাড়া কোন সমাজের কথা কল্পনা করা যায় না। প্রতিটি মানুষই সমাজে বাস করতে গিয়ে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে। সুতরাং সমাজবদ্ধ মানুষ এবং তাদের ভূমিকাকে সমাজ কাঠামোর উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। এজন্যই সমাজবিজ্ঞানী নেডেল সমাজের মানুষের ভূমিকার উপর ভিত্তি করে
সমাজ কাঠামোকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
২. পরিবার ও বিবাহ প্রথা : সমাজবদ্ধ মানুষ বংশবিস্তার এবং অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যেই পরিবার গঠন করে এবং বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। পরিবার সমাজে নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ করে, সামাজিকীকরণে সাহায্য করে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, বংশবিস্তার এবং সমাজের নৈরাজ্য নিরসনে সাহায্য করে। তাই সমাজজীবনকে সুশৃঙ্খল করতে হলে পরিবার ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় হতে হবে। সুতরাং বিবাহ এবং পরিবার সমাজ কাঠামো তথা সমাজের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
৩. ভাষা : সমাজবদ্ধ মানুষ মূলত ভাষার মাধ্যমেই পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। তাই সামাজিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে ভাষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভাষার ব্যবহার ছাড়া সমাজজীবন স্থবির, অনড়। ব্যক্তি তার মনোভাব ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ করে থাকে। তাই সামাজিক সংহতি ও মনোভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষা সমাজ কাঠামোর অন্যতম মৌলিক প্রত্যয় হিসেবে স্বীকৃত।
৪. অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান : মানুষের জীবনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করার উদ্দেশ্যেই অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সমাজব্যবস্থার সাথে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের ব্যক্তিগত চাহিদা ও উদ্দেশ্য পূরণের তাগিদে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব। সমাজ কাঠামো মূলত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে। তাইতো আদিম সমাজ থেকে শুরু করে বর্তমান সমাজ পর্যন্ত সমাজ কাঠামোর যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার মূলে রয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
৫. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান : সমাজ কাঠামোর সাথে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ জীবনের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য কোন অতিপ্রাকৃত শক্তির উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং ভাবে যে, এর দ্বারা তার সামাজিক সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। এরই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, বিধিবিধান পালন করে থাকে। ডুর্খেইম মনে করেন যে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সমাজে সংহতি স্থাপিত হয়।
৬. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান : সমাজের বিবর্তন ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন সমাজ কাঠামো ছিল এবং এর প্রেক্ষিতে আইন, শাসন এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। মূলত মানুষের জীবন তথা সমাজব্যবস্থা কিছু আইনকানুন এবং নিয়মনীতি দ্বারা পরিচালিত হয়, আর এ সুষ্ঠু পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র পরিচালনা, জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়, আইনব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রয়োগের জন্য রাজনৈতিক দল তথা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অপরিহার্য। সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সমাজ কাঠামো তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়।
৭. সামাজিক সংগঠন : সমাজ কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সামাজিক সংগঠন। সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে ব্যক্তি তার কাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে পারে এবং এর ফলে সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি পায়।
৮. মনস্তাত্ত্বিক উপাদান : সমাজ কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মনস্তাত্ত্বিক উপাদান। কারণ মনস্তাত্ত্বিক কারণেই সমাজস্থ মানুষের মধ্যে গোষ্ঠী চেতনা গড়ে উঠে। আর গোষ্ঠীগত চেতনা সমাজ কাঠামোর উল্লেখযোগ্য দিক এর গড়ে উঠে ।
৯. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : প্রতিটি মানবসমাজেরই একটি মৌলিক কার্যপ্রক্রিয়া হলো শিক্ষা। শিক্ষা হলো মানুষের মানবিক বিকাশের ক্ষেত্রে এক বিশেষ সুসংবদ্ধ ও সচেতন পদ্ধতি। ব্যক্তির সুপ্ত জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো শিক্ষার কাজ। শিক্ষা বলতে কেবলমাত্র নির্দিষ্ট বিষয়ে পাঠদান করাকেই বুঝায় না। এরিস্টটলের মতে, মানুষের বৃত্তি তথা মনের বিকাশ সাধনই হলো শিক্ষার মূল তাৎপর্য। তাই সমাজ বিকাশের বা উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
১০. চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা : সমাজস্থ মানুষ ব্যক্তিগত প্রশান্তির জন্য বিভিন্ন রীতিনীতি পালন করে, যার দ্বারা মানসিক শান্তি লাভ করে তাই বিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠান। এজন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- যাত্রা, খেলাধুলা, চলচ্চিত্র, থিয়েটার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জীবনে বৈচিত্র্য আনা সম্ভব। পারিবারিক ঐতিহ্য লালনপালন, মূল্যবোধ, চলচ্চিত্র প্রদর্শন এসব সামাজিক অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াও বৃদ্ধি পায় ।
১১. সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ : ব্যক্তি তার সামাজিকীকরণের মাধ্যমে সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হয়। সমাজে বসবাসরত ব্যক্তিবর্গের মনোভাব তুলনা করার মানদণ্ড হলো সামাজিক আদর্শ, যার মাধ্যমে ব্যক্তি তার সামাজিক বিধি ব্যবস্থা ও আচারব্যবহারের তাৎপর্য বিবেচনা করে তাই হলো সামাজিক মূল্যবোধ। এর দ্বারা ব্যক্তি
সমাজে কাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে শিখে। বটোমোরের মতে, ব্যক্তি তার সমাজতাত্ত্বিক মূল্যবোধ বা মূল বস্তুসমূহকে ঘটনা বা বিষয় হিসেবে অধ্যয়নের প্রয়াস পায়।
১২. বিভিন্ন গোষ্ঠী : গোষ্ঠী হলো ক্ষুদ্র বা বৃহৎ এমন একটি দল, যার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে এমন একটি সম্পর্ক, যা দলের সদস্যদেরকে একই সূত্রে গ্রথিত করে। এদের মধ্যে পারস্পরিক ভাবের আদানপ্রদান, আবেগ ও সংবেদনশীলতা রয়েছে। এদের সমষ্টিই হলো গোষ্ঠী যারা একে অপরের অঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় রত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সমাজ গঠনের মূলে রয়েছে ব্যক্তি। ব্যক্তি পরস্পরের সাথে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে। আর এ ভূমিকার ভিত্তিতেই বিভিন্ন গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। মূলত যে কোন সমাজকে জানার জন্য সংশ্লিষ্ট সমাজ কাঠামোকে জানার কোন বিকল্প নেই। সুতরাং সমাজ কাঠামো গড়ে
উঠে সমাজস্থ গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে।